অফবিট

শেষমেশ কী হয়েছিল লায়লা-মজনুর? কি বলছে বিখ্যাত এই ঐতিহাসিক প্রেম কাহিনী

লাইলি আর মজনুর প্রেম কাহিনীর কথা শোনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, জিজ্ঞাসা করলে বেশিরভাগই বলতে পারেন না তাদের কাহিনীটা আসলে কী ছিল। কীভাবে তাদের প্রেমের শুরু, কী তার পরিণতি- সে খুঁটিনাটিগুলো সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। চলুন আজ লাইলি-মজনুর আদ্যোপান্ত জেনে নেওয়া যাক।

অনেক কাল আগের কথা। আরবের বনু আমির বেদুইন গোত্রের এক মহান শাসক ছিলেন সায়িদ। অনেক ধন-দৌলতের মালিক ছিলেন তিনি। তাকে আরবের ধনাঢ্য সুলতানদের একজন বলে বিবেচনা করা হতো। হাতেম তাঈ এর মতো তার দানশীলতা আর প্রজাবাৎসল্যের কথা পৃথীবিতে ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু তার মনে ছিল একটাই দুঃখ। তার কোনো সন্তান ছিল না। যদি বংশের বাতিই না থাকে, কী হবে এত ধন দৌলত দিয়ে? তিনি দিন-রাত আল্লাহর কাছে মোনাজাত করতে থাকলেন একটি সন্তানের আশায়। আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করলেন।

একদিন ঘর আলো করে তার স্ত্রী জন্ম দিলেন এক পুত্রসন্তান। মুক্তোর মতো ত্বক, গালগুলো যেন গোলাপ দিয়ে রাঙানো। তার শরীর থেকে আলো বেরিয়ে যেন ঘর আলোকিত করে ফেলছে। মনের আনন্দে শিশুর বাবা তার ধনসম্পদ বিলাতে শুরু করলেন। প্রজাদের মনেও আজ আনন্দ।

শিশুর যত্নে একজন দক্ষ পালিকাও রাখা হলো। প্রতি মুহূর্তে যেন তার উপর নজর রাখা হয়। বদনজর থেকে রক্ষার জন্য তার চেহারায় টিপ দিয়ে দেয়া হলো।

দুই সপ্তাহের মাথায় শিশুটির নাম রাখা হলো কায়েস। বাবার নাম আল-মুলাওয়াহ হওয়াতে শিশুটির পুরো নাম হলো কায়েস ইবন আল-মুলাওয়াহ।

বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সৌন্দর্য যেন ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগলো। যখন তার বয়স সাত তখন প্রথম দাড়ির আভাস দেখা গেল চেহারায়। তাকে মক্তবে পাঠানো হলো পড়ালেখার জন্য। শীঘ্রই মক্তবের সেরা ছাত্র হয়ে উঠল কায়েস।

মক্তবে শুধু ছেলেরাই পড়ত না, মেয়েরাও পড়ত। একসঙ্গেই পড়ত তারা। বিভিন্ন গোত্রের সম্ভ্রান্ত সব পরিবার থেকে মেয়েরা পড়তে আসত। কিন্তু একদিন নতুন এক মেয়ে এসে যোগ দিল তাদের সঙ্গে। কায়েসের মনে হলো, এত সুন্দর মেয়ে সে আগে কখনো দেখেনি। তাদের বয়স অবশ্য তখনও দশ পেরোয়নি।

মেয়েটির নাম লায়লা, বাংলায় যার মানে ‘রাত্রি’। লায়লা আল-আমিরিয়া (কিংবা, লায়লা বিনতে মাহদি)। লায়লা যেন উলুবনে ছড়ানো এক মুক্তা। ছিপছিপে তার দেহ। মায়াকাড়া হরিণীর মতো তার চোখ। তার এক অলস দৃষ্টিতেই যেন হাজারো হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

সত্যিই, কাজল দেয়া লায়লার চোখের পলক যেন পুরো দুনিয়াকে ছারখার করে দিতে পারে। তার চেহারা যেন আরবের আকাশের চাঁদ, কিন্তু হৃদয় ছিনিয়ে নেওয়ার বেলায় সে যেন পারস্যের ডানাকাটা পরী। ঘন কালো চুলের খোপে তার মুখ যেন প্রদীপের মতো উজ্জ্বল, কাকের মতো কালো সেই চুল যেন তার রাত্রিময় নামই মনে করিয়ে দেয়। আর কোকিলের কন্ঠে যখন লায়লার কথা শোনা যায়, তখন মনে হয়, এ-ও কি সম্ভব? এত সুন্দর হতে পারে কারো কণ্ঠ? তবে তো সূর্যও পশ্চিম দিক দিয়ে ওঠা খুব সম্ভব। যে দুধে সে চুমুক দেয়, সেটিও যেন গোলাপী হয়ে ওঠে তার ঠোঁটের পরশে। কে সেই ভাগ্যবান মানুষটি যে কি না পাবে টানা টানা কামনার চোখের এ মেয়েটিকে, যার গালের ওই ছোট তিলটিও যেন পুরো দুনিয়ার যেকোনো কিছু থেকে সুন্দর? শুধু সুন্দর না, অসম্ভব সুন্দর।

তো সেই প্রথম দিন থেকেই লায়লার প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগলো কায়েস। সেই ছোট বয়স থেকেই, বাল্যপ্রেম যাকে বলে। তখন থেকেই সুন্দর সুন্দর কবিতা লেখা শুরু করল লায়লাকে নিয়ে, আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে সেই কবিতা আবৃত্তি করতে থাকত। কেউ শুনতে না চাইলে পারলে যাকে তাকে দাঁড়া করিয়ে শোনাতো। এককথায় পুরো পাগল হয়ে গেল লায়লার জন্য। লোকে তাকে কায়েস না ডেকে তাই ডাকতে লাগলো ‘মাজনুন’ বা দিওয়ানা, পাগল। বাংলায় আমরা বলি, মজনু।

একদিন মজনু লায়লার বাবার কাছে গিয়ে লায়লাকে বিয়ে করতে চাইল। কিন্তু লায়লার বাবা সঙ্গে সঙ্গে না করে দিল। এ ছেলের কাছে বিয়ে দেয়াই হবে অপমানের ব্যাপার, লোকে একে মজনু ডাকে, পাগল ডাকে। পাগলের কাছে বিয়ে দেবেন নিজের মেয়েকে?

ওদিকে, লায়লা কিন্তু এ পাগল ছেলেটিকে ঠিকই ভালোবাসত। তিনি নিজের মেয়ের বিয়ে ঠিক করলেন পাশের গ্রামের এক বয়স্ক লোকের সঙ্গে।

রাগে, দুঃখে আর শোকে মজনু তার পরিবার ত্যাগ করল, জঙ্গলে চলে গেল। সেখানে গিয়ে হিংস্র জীবজন্তুর সঙ্গে দিন কাটাতে লাগলো। সেখানে বসে বসেই সে লায়লাকে নিয়ে তার কবিতা লিখত।
লায়লাকে জোরপূর্বক বিয়ে করতে হলো সেই বুড়ো লোকটিকে। ঘর-সংসার সে করতে থাকলো বটে, কিন্তু বুড়ো মন পায়নি তার। মন তার মজনুর জন্যই কাঁদত। কিন্তু সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে হিসেবে ভালো মেয়ে সেজেই স্বামীর ঘর করতে থাকলো লায়লা।

লায়লার বিয়ের খবর মজনুর কাছে যখন পৌঁছালো, সে আরো পাগল হয়ে গেল। তখনও সে বাবা-মায়ের কাছে ফিরতে নারাজ। তার বাবা-মা প্রতিদিন তার জন্য খাবার সাজিয়ে রাখত বাগানবাড়িতে, এই আশায় যে একদিন তাদের ছেলে ফিরে আসবে। কিন্তু মজনু রয়ে গেল জঙ্গলেই।

মাঝে মাঝে কিছু পথিক দেখা পেত মজনুর, তারা জানাতো মজনু একা একাই কবিতা আবৃত্তি করে, বালুতে কাঠি দিয়ে কবিতা লিখে। লায়লার কারণে ভেঙে পড়েছে পুরোই।

বহু বছর পর, মজনুর বাবা-মা দুজনেই মারা গেল। লায়লা নিজে সে খবর পাঠাতে চাইলো মজনুর কাছে, কিন্তু কাকে দিয়ে পাঠাবে? এক বুড়ো লোককে ধরে রাজি করালো সে। বুড়ো রাজি হলো, যদি পরে কোনোদিন দেখা পায় মজনুর, তবে জানিয়ে দেবে।

একদিন যখন আসলেই মজনুর দেখা পেল বুড়ো, তখন জানালো তার বাবা-মায়ের মারা যাবার খবর। দুঃখে ভারাক্রান্ত মজনু কোনোদিন শহরে ফিরবে না মৃত্যুর আগে সে কসম কাটলো।

কয়েক বছর পর, লায়লার স্বামী মারা গেল। তখন লায়লা আশা করছিল, অবশেষে সে তার মনের মানুষের সঙ্গে মিলিত হতে পারবে। আমৃত্যু কাছে থাকতে পারবে দুজনে। কিন্তু বেদুইন রীতি বলে, বিধবাকে অন্তত দুই বছর ঘর থেকে বের না হয়ে শোক পালন করতে হবে। কিন্তু দুই বছর কীভাবে মজনুকে না দেখে থাকবে লায়লা? সেই দুঃখে লায়লা মারা গেল নিজের বাড়িতেই।

লায়লার মৃত্যুর খবর বনে জঙ্গলে থাকা মজনুর কাছে পৌঁছালো। সঙ্গে সঙ্গেই সে লায়লার কবরের জন্য রওনা দিল। সেখানে পৌঁছে সে কাঁদতেই থাকলো, যতক্ষণ পর্যন্ত মজনুর মৃত্যু হয়নি। একসময় লায়লার কবরের ওপর পড়ে রইল মজনুর নিথর দেহ।

ভারতে এমন উপকথাও প্রচলিত আছে যে, লায়লি-মজনু মারা যায়নি, বরং রাজস্থানে চলে আসে, সেখানেই তারা মৃত্যু পর্যন্ত ছিল। বিশ্বাস করা হয়, লায়লি-মজনুর মাজার রাজস্থানের অনুপগড়ে।

কিছু কিছু সংস্করণে বেশ রক্তপাতও দেখা যায়। যেমন, একটি সংস্করণ বলছে, মজনু মার খেত যখনই, তখন লায়লারও রক্ত ঝরত জাদুবশে। এমনকি লায়লাকে বিয়ে করতে লায়লার ভাই তাবরেজকে খুন করেছিল, কারণ তাবরেজ এ বিয়ের ঘোরবিরোধী ছিল। এ খুনের জন্য পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড হয় মজনুর, তাই মজনু পালিয়ে গিয়েছিল। আবার লায়লার প্রেমের কথা জানবার পর মজনুকে মারবার জন্য লায়লার স্বামী জঙ্গলে যায়, সেখানে তারা দ্বন্দ্বযুদ্ধ করে। যখন লায়লার স্বামী মজনুর বুকে তলোয়ার ঢুকিয়ে দেয়, তখন ঘরে বসা লায়লা ঢলে পড়ে মাটিতে। দুজনে একইসঙ্গে মারা যায়, এবং পাশাপাশি কবর দেয়া হয়।

কথিত আছে, দুজনের বাবা তাদের জন্য প্রার্থনা করেন। উপকথা অনুযায়ী, তারা দুজন স্বর্গে মিলিত হবে, সেখানেই তাদের বিবাহ হবে এবং চিরকাল সুখে শান্তিতে কাটিয়ে দেবে।

Back to top button