অফবিট

বিশেষ: মানুষের রক্তে লেখা শয়তানের এই বই, কী আছে এতে? জেনেনিন বিস্তারিত

৩১০ পৃষ্ঠার দানবাকৃতির একটি বই, যা কিনা লেখা হয়েছিল মাত্র এক রাতেই। কাঠের মলাটের সেই বইয়ের পাতায় পাতায় আছে আশ্চর্য সব গা ছমছমে ছবি। যেকোনো সাধারণ কালিতে নয়, শোনা যায় এই পাণ্ডুলিপি লেখা হয়েছিল মানুষের রক্ত দিয়ে। হাতে লেখা সবচেয়ে বড় এই পাণ্ডুলিপির নাম ‘ডেভিলস বাইবেল’ বা ‘শয়তানের বাইবেল’।

 

প্রায় ত্রিশ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬৪৮ সাল নাগাদ এক মেঘলা দুপুরে প্রাগ শহরে ঢুকে পড়ে সুইডিশ সেনা। শুরু হয় লুঠতরাজ। ধনসম্পত্তি যেখানে যা ছিল সব হাতিয়ে নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় তাদের চোখ যায় প্রাগের লাইব্রেরিতে সযত্নে সাজিয়ে রাখা একটা বিরাট বইয়ের পাণ্ডুলিপির দিকে। তাতে কী লেখা আছে জানা না থাকলেও, বইটার চেহারা দেখেই বোঝা গেছিল, এমন বই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। তাই ধনসম্পদের সঙ্গে বইটিও লুঠ করে খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে নিজেদের দেশে নিয়ে আসে তারা।

ছোট ছোট পাহাড়ে ঘেরা মোরাভা নদীর দেশ আজকের চেক প্রজাতন্ত্র। সেই দেশেরই কোনো এক মঠে খুব গোপনে ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে লেখা হয়েছিল এই বই। আগাগোড়া ল্যাটিন ভাষায় লেখা এই বিরাট চেহারার বইটার আসল নাম ‘কোডেক্স গিগাস’। মনে করা হয়, হারম্যান রিকুলাস নামে চেকোশ্লোভাকিয়ার এক সন্ন্যাসী মাত্র এক রাতের মধ্যে লিখেছিলেন এই বিশাল আকৃতির বই। আবার কারো কারো মতে, এক রাতের মধ্যে এত বড় বই লেখা কোনো সাধারণ মানুষের কাজ নয়। তারা বিশ্বাস করে এই বইটির রচয়িতা কোনো মানুষ নয়, এই বইয়ের লেখক স্বয়ং শয়তান।

কাঠের তৈরি কভার আর তার উপর চামড়ার পুরু মলাট আর ধাতু দিয়ে বাঁধানো এই বিশাল পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো মোটেও কাগজের নয়। পাতাগুলো তৈরি হয়েছে পশুর গায়ের চামড়া দিয়ে। হিসেব বলছে, ৩১০ পৃষ্ঠার এই বইটি তৈরির জন্য শুধু চামড়ার জোগান দিতেই মারা পড়েছিল ১৬০টা গাধা বা বাছুর। ৩৬ দশমিক ২ ইঞ্চি লম্বা, প্রায় ২০ ইঞ্চি চওড়া এবং ৮ দশমিক ৭ ইঞ্চি পুরু এই বইয়ের আয়তন এক হাজার ৫৩২ স্কোয়্যার ফুট। একা একজন মানুষের পক্ষে এ বই বয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। প্রায় ৭৫ কেজি ওজনের এই বই এতটাই ভারী, যে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিতে গেলেও অন্তত দু থেকে তিনজন মানুষের দরকার পড়ে।

এই বইয়ের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে রহস্য। প্রথম দিককার পাণ্ডুলিপিতে না কি ৩২০টা মতো পাতা ছিল। পরবর্তীকালে কোনো অজানা কারণে কে বা কারা ছিঁড়ে নেয় শেষ দিকের বেশ কিছু পাতা। কী লেখা ছিল সেই পাতায়? কেনই বা ছিঁড়ে নষ্ট করে ফেলতে হত সেই তথ্য- এ প্রশ্নের উত্তর আজও হাতড়ে চলেছেন ঐতিহাসিকেরা।

কিন্তু এমন নাম কেন এই বইয়ের? কেন ‘শয়তানের বাইবেল’ নামে ডাকা হয় এই বইটাকে?

এর পেছনেও রয়েছে এক আশ্চর্য গল্প। শোনা যায়, ত্রয়োদশ শতকের কোনো এক সময়ে একটি অপরাধ করে বসেন কোনো এক খিষ্টান মঠের সন্ন্যাসী। ধরা পড়ায় সেই অন্যায়ের জন্য এক নির্জন কারাগারে একা বন্দি করে রাখা হয় তাকে। বিচারে সন্ন্যাসীকে জীবন্ত গোর দেওয়ার হুকুম দেন রাজা। ভয় পেয়ে যান সন্ন্যাসী। প্রাণভিক্ষা করেন রাজার কাছে। বলেন নিজের সততার প্রমাণ দেবেন তিনি। একরাতের মধ্যে লিপিবদ্ধ করে ফেলবেন পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞান। হারানো সুনাম ফিরিয়ে আনবেন মঠের।

যেমন কথা তেমন কাজ। রাজার সম্মতিক্রমে শুরু হল সেই পাণ্ডুলিপি লেখার কাজ। একা, নির্জনে বসে মোমের আলোয় তিনি খসখস করে লিখে চললেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। কিন্তু এক রাত্রে কতটা আর লেখা যায়! মধ্যরাত পেরিয়ে হুঁশ ফিরল সন্ন্যাসীর। বুঝলেন, অসম্ভব এক প্রতিজ্ঞা করে বসেছেন। এদিকে সকালের মধ্যে পাণ্ডুলিপি লেখা শেষ না হলে মৃত্যু অনিবার্য। ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে আসে সন্ন্যাসীর মুখ।

নিরুপায় সন্ন্যাসী বুঝতে পারলেন, পৃথিবীর কোনো মানুষ একরাতের  ভেতর এই বই শেষ করতে পারবে না। সে অবস্থায় তার কাছে একটাই পথ খোলা ছিল। আর ভাবার সময় নেই বুঝতে পেরে সন্ন্যাসী একপাশে বসে মন্ত্র পড়া শুরু করলেন। তাতেও কাজ না হওয়ায় তিনি শেষমেশ নিজের রক্ত দিয়ে একটা চিঠি লিখলেন শয়তানকে। সেই ভয়ংকর চিঠিতে তিনি শয়তানের কাছে এই বলে সাহায্য কামনা করেন যে, শয়তান যদি তাকে এই বই লিখতে সাহায্য করে তবে তিনি অনন্তকালের জন্য নিজের আত্মা সঁপে দেবেন শয়তানের হাতে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে মধ্যরাতের অন্ধকারে ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে সেই কারাগারে নেমে আসে এক বীভৎস প্রেতমূর্তি। সেই প্রেত আর কেউ নয়, স্বয়ং নরকের রাজপুত্র লুসিফার।

সন্ন্যাসীর হাত থেকে নিজের হাতে কলম তুলে নেয় শয়তান। ঝড়ের বেগে শুরু হয় কোডেক্স গিগাস লেখা। যে বই লিখতে গেলে একজন মানুষকে নাওয়া-খাওয়া ভুলে একটানা কুড়ি বছর লিখে যেতে হত, সেই বই লেখা হয়ে যায় মাত্র একরাতের মধ্যে। নিজের উপস্থিতি জানান দিতে সেই বইয়ের একটা পাতায় নিজের বিরাট এক ছবিও একে যায় লুসিফার।

সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সেই সদ্য লেখা নতুন পাণ্ডুলিপি নিয়ে রাজার সামনে হাজির হন সন্ন্যাসী। রাজদরবারের সবাই তাজ্জব বনে যায় সেই বইয়ের অতিমানবিক চেহারা দেখে। বিস্ময়ে থ হয়ে যান রাজাও। মনে পড়ে যায় নিজের প্রতিশ্রুতি। একরাতের মধ্যে বিশ্বের সমস্ত জ্ঞান সংকলিত করতে যিনি পারেন, তার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দেন রাজা। মুক্তি পায় সন্ন্যাসী। কিন্তু মুক্তি পেয়েই বা লাভ কি? তার আত্মা অনেক আগেই বন্দি হয়ে গেছে শয়তানের হাতে। মন্দের কারাগার থেকে আর নিষ্কৃতি নেই তার।

কী লেখা আছে এই শয়তানের বাইবেলে?

ইতিহাসবিদদের মতে, কোডেক্স গিগাস মধ্যযুগের এক জ্বলজ্যান্ত বিশ্বকোষ। এই বইতে ল্যাটিন ভাষায় লেখা হয়েছে গোটা বাইবেল। পাণ্ডুলিপির শুরুতেই লেখা হয়েছে পবিত্র ওল্ড টেস্টামেন্ট অংশটি। বাইবেলের পুরোনো আর নতুন টেস্টামেন্ট ছাড়াও লাতিন ভাষায় লেখা অন্য বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বইও সংকলিত করা হয়েছে এই পাণ্ডুলিপিতে, যার মধ্যে অন্যতম হলো- ফ্লেভিয়াস জোসেফাসের ইহুদি যুদ্ধ ও ইহুদি পুরাতত্ত্ব, সেইন্ট ইসিডোর রচিত বিশ্বকোষ ‘এটিমোলোজিয়া’, প্রাগের কসমাস রচিত ‘ক্রনিক্যল অফ বোহেমিয়া’ বইগুলো। এছাড়াও চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত বেশ কিছু লেখাপত্রও সংকলিত আছে কোডেক্স গিগাসে।

আশ্চর্য এই পাণ্ডুলিপি! কত কি অদ্ভুত বিষয়ই না জায়গা পেয়েছে এর মধ্যে! বিভিন্ন অসুখ আর তার চিকিৎসা পদ্ধতির বর্ণনা যেমন আছে, তেমনই ভয়ঙ্কর সব অভিশাপ আর তা থেকে প্রতিকারের উপায়ও লেখা আছে এই পাণ্ডুলিপিতে। আত্মা বশীকরণ ও লালন-পালনের পদ্ধতি, ব্ল্যাক ম্যাজিকের আচার ও মন্ত্রসহ নানান বিষয়েরও সমাধান দেওয়া আছে এতে। কীভাবে ডাইনি চেনা যায় তার বর্ণনাও রয়েছে এই বইয়ের পাতায়।

এই বই লেখার সময় লাল, নীল, হলুদ, সবুজ ও সোনালি রঙের ব্যবহার করা হয়েছে। মানুষ বা পশুপাখির ছবির বদলে বেশিরভাগ অলংকরণেই জ্যামিতিক চিত্র বা গাছপালার ছবি দেখা যায়। কিন্তু দুটো ছবি বিশেষভাবে নজর কেড়েছে ঐতিহাসিকদের। সেই দুটি ছবি হল, সৃষ্টির সময়কার স্বর্গ ও পৃথিবীর ছবি। এই ছবি দুটিতে নীল ও সবুজ বৃত্তের আকারে যথাক্রমে সূর্য, চাঁদ আর কয়েকটা তারা এবং একটি গ্রহ বোঝানো হয়েছে। গ্রহটিতে কোনো ভূখণ্ড নেই, পুরোটাই সমুদ্রে ঘেরা।

কিন্তু এ বইয়ের সবচেয়ে আশ্চর্য ছবিটা রয়েছে পাণ্ডুলিপির ২০৯ পৃষ্ঠায়। সেই ছবি যে নরকের রাজপুত্র লুসিফারের, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু খটকা আছে অন্য জায়গায়। মনে করা হয় এই ছবিটা শয়তানের নিজের হাতে আঁকা নিজের প্রতিকৃতি। অথবা হারম্যান রিকুলাস নামের ওই সন্ন্যাসীই শয়তানের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানোর জন্য পাতাজোড়া এই শয়তানের ছবিটি এঁকেছিলেন।

তখনকার দিনের ধর্মগ্রন্থে শয়তানের ছবি দেখা যেত প্রায়ই। কিন্তু কোডেক্স গিগাসের এই ছবিটা নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। প্রথমত শয়তানে এখানে প্রায় নগ্ন আর একা। সঙ্গে তার অনুগামী বা সেনাবাহিনীর কেউ নেই। এছাড়া ছবিতে লুসিফারকে সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে থাকা অবস্থায় আঁকা হয়েছে। হঠাৎ করে তাকালে হাড় হিম হয়ে যায়। মনে হইয় এই বুঝি বই থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়বে সে।

কম তর্কবিতর্ক হয়নি এই বই নিয়ে। বৈজ্ঞানিকেরা একটা ব্যাপার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকের লেখার সংকলন নয়, এ বই যে একজনেরই হাতে লেখা, লিপির সাদৃশ্য দেখেই প্রমাণ হয় তা। কিন্তু এমন দানবাকৃতির বই, একজন মানুষ তার জীবৎকালে লিখতে পারে কী না, সে প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা।

সুইডিশদের হাতে এই বই পড়ার পর ১৬৪৯ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত বইটি রাখা ছিল স্টকহোমের সুইডিশ রয়্যাল লাইব্রেরিতে। এর মধ্যে ১৬৯৭ সাল নাগাদ আগুন লেগে যায় রয়্যাল লাইব্রেরিতে। ওই দুর্ঘটনায় অনেক দামি বই পুড়ে নষ্ট হয়ে গেলেও আশ্চর্যজনকভাবে কোডেক্স গিগাসের গায়ে আঁচড়টাও লাগেনা। ২০০৭এর সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় ৩৬০ বছর পর শয়তানের বাইবেলকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে তার নিজের শহর প্রাগে। এখন তার স্থায়ী ঠিকানা প্রাগের ন্যাশনাল লাইব্রেরি। যদিও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিছু কড়াকড়ি করা হয়েছে। এখন আর সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয় শয়তানের বাইবেল।

Back to top button