আন্তর্জাতিক

বিশেষ: উত্তর কোরিয়ার ‘ত্রাস’ কিম জং উন, যাকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয় গোটা বিশ্বের

আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতিকে কাঁচকলা দেখিয়ে ২০২২ সালের শুরু থেকেই একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে প্রায় ‘দুর্বিনীত রাষ্ট্র’ হিসেবে অভিহিত উত্তর কোরিয়া। পুরো বিশ্বের নজর দেশটির নেতা কিম জং উনের দিকে। সবাই অপেক্ষায় থাকেন, এরপর ‘আর কী করবেন কিম?’

বিশ্লেষকদের মতে, বছরের প্রথম ৪ সপ্তাহে ৭টি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার মাধ্যমে কিম জং উন একই সঙ্গে তার আভ্যন্তরীণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছেন এবং বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছেন যে, এই ঝঞ্জাবিক্ষুদ্ধ সময়েও উত্তর কোরিয়া আমলে নেওয়ার মতো পরাশক্তি। আর সঙ্গে এটাও প্রমাণ করেছেন যে, তাদেরকে অবজ্ঞা করার কোনো উপায় নেই।

দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের ইউহা ওম্যান্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক লেইফ-এরিক ইসলি সিএনএনকে জানান, যেখানে সারা বিশ্ব করোনাভাইরাস মহামারিতে বিপর্যস্ত, সেখানে উত্তর কোরিয়া এশিয়ার পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে নিজেদেরকে ‘পারমাণবিক শক্তিধর’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, যে ৭টি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করা হয়েছে সেগুলোকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও প্রযুক্তির প্রদর্শনী হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে, ‘হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল’। এটিকে বলা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র ব্যবস্থা। এর পাশাপাশি মধ্যম পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও (আইআরবিএম) রয়েছে, যেটি ২০১৭ সালের পর উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘতম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। তারা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও পরীক্ষা করেছে, যেটি দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পরাশক্তির অস্ত্রাগারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

কিম জং উনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, দেশটি এখন শুধুমাত্র প্রতিবেশী ও শত্রু হিসেবে বিবেচিত দক্ষিণ কোরিয়া নয়, দূরবর্তী দেশ যুক্তরাষ্ট্রকেও আঘাত করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। গতকাল ৩০ জানুয়ারি পরীক্ষা চালানো মধ্যম পাল্লার আইআরবিএম ক্ষেপণাস্ত্রটি প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের শাসনাধীন গুয়াম দ্বীপে আঘাত হানতে সক্ষম।

দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক দৃশ্যপটে পরিবর্তন

আগামী মার্চে দক্ষিণ কোরিয়ার সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। লি জায় মিউংয়ের নেতৃত্বাধীন ডেমোক্র্যাটদের পরাজিত করে রক্ষণশীল প্রার্থী ইউন সুক ইউলের রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে । লি জায় মিউং জয়ী হলে তিনি বর্তমান রাষ্ট্রপতি ও সহকর্মী মুন জায়ে-ইনের স্থলাভিষিক্ত হবেন।

বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, ইউলের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নিতে পারে। সেটা কিম জং উনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

ইউল এমনকি এটাও বলছেন যে, প্রয়োজনে দক্ষিণ কোরিয়া উদ্যোগী হয়ে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালাবে। এতে দক্ষিণ কোরিয়া সম্ভাব্য বড় আকারের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পারবে এবং উত্তর কোরিয়াও সতর্ক হয়ে যাবে।

গত সপ্তাহে ইউল বলেন, ‘আমাদের জন্য এ ধরনের মনোভাব বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান সরকার কিমের সঙ্গে সম্মেলনে করেছে। কিন্তু ইউল ক্ষমতায় আসলে তিনি কিমের শাসনকেই অবজ্ঞা করতে পারেন। এমনটাই ভাবছেন সিওলের কুকমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন্দ্রেই ল্যাংকভ।

ভালদাই ক্লাব নামের একটি রাশিয়ান থিংক ট্যাংকের ব্লগে ল্যাংকভ লিখেছেন, ‘রক্ষণশীলরা উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কঠোর অবস্থানে যেতে যতটা আগ্রহী, তারচেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী আরেকটি কোরিয়া রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই পুরোপুরি অস্বীকার করার ব্যাপারে।’

তবে রোববারের আইআরবিএম পরীক্ষা দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি মুনের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে।

রাষ্ট্রপতি মুন একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, আইআরবিএম পরীক্ষা থেকে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে কিম সরকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম) এবং পারমাণবিক পরীক্ষার ওপর সাক্ষরিত স্থগিতাদেশ উপেক্ষা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

কিমের পরীক্ষা কী কেবল বাইডেনের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা?

ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ও তার প্রশাসন উত্তর কোরিয়াকে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেনি। তারা করোনাভাইরাসের পাশাপাশি চীন, তাইওয়ান এবং সাম্প্রতিককালে ইউক্রেন নিয়ে অনেক বেশি মনোযোগী।

২০১৭ সালে ক্ষমতায় থাকাকালীন উত্তর কোরিয়ার উস্কানিমূলক আচরণে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি বললেই চলে।

রোববার এক মার্কিন কর্মকর্তা ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের জানান, ওয়াশিংটন পিয়ং ইয়ংয়ের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী। তবে তারা বাইডেন ও কিমের মধ্যে সরাসরি বৈঠকের বদলে আরও নিম্নপর্যায় থেকে বৈঠক শুরুর পক্ষে।

এটা নিঃসন্দেহে কিমের জন্য হতাশাজনক। কারণ তিনিই প্রথম কোনো উত্তর কোরীয় নেতা হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের (ট্রাম্প) সঙ্গে ৩ বার সশরীরে বৈঠক করেছিলেন।

বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৭ সালে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইলের (আইসিবিএম) পরীক্ষা চালিয়ে কিম মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে বাধ্য করেন তার সঙ্গে বৈঠকে বসতে। তাত্ত্বিকভাবে, এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মার্কিন ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম। তবে বৈঠক থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো ফল না পাওয়ায় উত্তর কোরিয়া আবারও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা শুরু করেছে বলেই ভাবছেন তারা।

বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর ৮টি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে উত্তর কোরিয়া। তবে, এর সবগুলোই ছিল স্বল্প থেকে মধ্যম পাল্লার। তবে রোববারের আইআরবিএম পরীক্ষা থেকে বোঝা যাচ্ছে কোরিয়ার অস্ত্রভাণ্ডারে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এ সময়ে এরকম একটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রতি আরেকটি আঘাত। আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার, ইউক্রেনের সীমান্তে রাশিয়ার সৈন্য মোতায়েন এবং ইউরোপে সম্ভাব্য যুদ্ধের মতো বিষয়গুলো নিয়ে তারা বেশ ঝামেলায় আছে।

২০২২ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য মার্কিন কংগ্রেস নির্বাচনে এ বিষয়গুলো বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বাইডেনের ডেমোক্র্যাট দল মার্কিন হাউস ও সিনেট উভয় কক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে পারে। এতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাকি মেয়াদে বাইডেনের জন্য তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করা বেশ কঠিন হয়ে যাবে।

এ মুহূর্তে উত্তর কোরিয়া আইসিবিএম পরীক্ষা চালালে তা বাইডেন ও তার দলের পররাষ্ট্রনীতির ওপর বড় ধরনের আঘাত হবে।

কিম জং উনের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও মাইলফলক অর্জনের অভিযান

২০২১ সালের জানুয়ারিতে উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন দলের ৮ম পার্টি কংগ্রেসে যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন কিম, তা একে একে পূরণ করেছেন।

প্রথম লক্ষ্য ছিল হাইপারসনিক ওয়ারহেডের পরীক্ষা, যা এ মাসেই সম্পন্ন হয়েছে। আরেকটি লক্ষ্য ছিল ডুবোজাহাজ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ পরীক্ষা, যা গত অক্টোবরে সফল হয়।

আরেকটি লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন ধরনের অভিযানের উপযোগী ‘ট্যাকটিকাল পারমাণবিক অস্ত্র’ নির্মাণ। উত্তর কোরিয়ার জাতীয় গণমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী, এ মাসের পরীক্ষাগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘ট্যাকটিকাল ক্ষেপণাস্ত্রের’ পরীক্ষা। যেহেতু আইসিবিএমও এক ধরণের ট্যাকটিকাল ক্ষেপণাস্ত্র, সুতরাং বিশ্লেষকরা ভাবছেন যেকোনো সময় উত্তর কোরিয়া এর পরীক্ষা চালাবে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, উত্তর কোরিয়ার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো যোগসূত্র নেই। তারা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী একের পর এক ‘পারমাণবিক অস্ত্র’ এর মাইলফলক অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

উত্তর কোরিয়ার প্রধান মিত্র দেশ চীনে শীতকালীন অলিম্পিক শুরু হতে যাচ্ছে শিগগির। ধারণা করা হচ্ছে, এ উপলক্ষে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষায় বিরতি দেবেন কিম।

উত্তর কোরিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পার্ক ওন-গন জানান, উত্তর কোরিয়ার সামরিক শক্তি বাড়লে যুক্তরাষ্ট্রকে সেদিকে বেশি নজর দিতে হয়। তখন চীন-তাইওয়ান ইস্যু থেকে তাদের নজর কোরিয়ার দিকে ঘুরে যায়, যেটি চীনের জন্য সুবিধাজনক।

তবে এতকিছুর পরে কিম বিশ্বের পরাশক্তিদের সঙ্গে একই টেবিলে বসার সুযোগ যদি নাও পান, তাহলেও এটুকু অন্তত বলা যায় তিনি তাদের দরজায় কড়া নাড়তে পেরেছেন এবং খুব শিগগির তার জন্য দরজা খুলেও যেতে পারে। প্রকারান্তরে, কিম জং উন পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করতে চান, আর যাই করুন না কেন তাকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।

তথ্য সূত্র: লেখক মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান ও দা ডেইলি ষ্টার

Back to top button