‘গুলি খেয়ে পড়ে আছি, সরকার কোথায়?’ক্ষোভ ইউক্রেনে জখম ভারতীয় ছাত্রের, মন্ত্রী বলেন, যুদ্ধে হয়েই থাকে
ট্রেনে উঠতে দেওয়া হয়নি। ট্যাক্সি ভাড়া করে কিয়েভ ছাড়ার চেষ্টা করলেও ফেরত পাঠানো হয় চেকপয়েন্ট থেকে। ফেরার সময় গাড়ি লক্ষ্য করে চলে এলোপাথাড়ি গুলি। তিনটি বুলেট ফুঁড়ে দেয় ভারতীয় পড়ুয়া হরজ্যোৎ সিংয়ের কাঁধ, বুক এবং হাঁটু। সেই অবস্থাতেই বেশ কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় পড়েছিলেন তিনি। অ্যাম্বুলেন্স না আসা পর্যন্ত। ঘটনাটি গত ২৭ ফেব্রুয়ারির।
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে হরজ্যোতের ঠিকানা ইউক্রেনের কিয়েভ সিটি হাসপাতাল। মাত্র ২০ মিনিট দূরে ভারতীয় দূতাবাস। বারবার ফোন করা সত্ত্বেও সেখান থেকে কোনও সাড়া মেলেনি। কারণ, দূতাবাস কর্মীরা পোল্যান্ড সীমান্তের কাছে লাভিভের দিকে রওনা দিয়েছেন। পাও ভেঙে গিয়েছে হরজ্যোতের। যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ছে। গুলি-বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ব্যবধান কমে আসছে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে টের পাচ্ছেন তিনি। ‘গুলি খেয়ে পড়ে রয়েছি। সরকার কোথায়? আমার মৃত্যুর পর চার্টার প্লেন পাঠিয়ে লাভ কী?’ ভিডিও কলে হরজ্যোতের ক্ষোভ শুক্রবার সকাল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সংবাদমাধ্যমে। মোদি সরকার অবশ্য তাতে কতটা কর্ণপাত করেছে বলা মুশকিল। পোল্যান্ড থেকে ভারতীয়দের ফেরাতে ‘অপারেশন গঙ্গা’-র দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান ভি কে সিং জানিয়েছেন, ‘আজ আমরা খবরটা শুনেছি। যুদ্ধে এমনটা হয়েই থাকে।’ সরকারে এহেন মনোভাবে ক্ষোভ বাড়ছে আটকে থাকা ভারতীয় পড়ুয়াদের মধ্যে।
উত্তর-পূর্ব ইউক্রেনের সুমি শহর প্রায় তছনচ হয়ে গিয়েছে রুশ সেনার আক্রমণে। বাইরের তাপমাত্রা মাইনাসে। তুষারাবৃত গোটা শহর। কোথাও বিদ্যুৎ নেই। তীব্র জলসঙ্কট। মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট অব সুমি স্টেট ইউনিভার্সিটির হস্টেলে আটকে পড়েছেন প্রায় এক হাজার ভারতীয় ছাত্রছাত্রী। বৃহস্পতিবার হস্টেলের কাছেই বিস্ফোরণ হয়েছে। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হতে দেখে এদিন তাঁরা ভিডিও বার্তায় মরিয়া আর্জি জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে, ‘আমাদের এখান থেকে নিয়ে যান। নয়তো মারা পড়ব। আমরা নিজেরা এখান থেকে বেরতে গেলেও মরব।’ পরিস্থিতি কেমন? তার আভাস দিয়েছেন আটকে পড়া এক ছাত্র। বলছেন, ‘গতকাল রাত থেকে জল খাইনি। বরফ গলিয়ে কেউ কেউ খাচ্ছে। ২০ মিনিট অন্তর বোমা পড়ছে। রুশ সীমান্ত এখান থেকে প্রায় ৫০ কিমি। কেউ কেউ বলছেন সীমান্তে বাস অপেক্ষা করছে। কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট তথ্য কেউ দেননি। শোনা যাচ্ছে, শহরের বাইরে রাস্তা-সেতু সব ভেঙে দিয়েছে রুশ সেনা। কীভাবে বেরব?’
গুলিবিদ্ধ হরজ্যোৎ রাজধানী দিল্লির ছত্তরপুরের বাসিন্দা। তাঁর মতো অনেক ভারতীয় পড়ুয়া এখনও ইউক্রেনের রাজধানীতে আটকে। রুশ আক্রমণ শুরু হতেই কিয়েভ ছাড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। সঙ্গী হন আরও দু’জন। হরজ্যোৎ জানিয়েছেন, কিয়েভ স্টেশনে ট্রেনে চাপতে দেওয়া হয়নি। ট্যাক্সি করেই পোল্যান্ড সীমান্তে পালাতে চাইছিলেন। কিন্তু তৃতীয় চেকপয়েন্ট থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ফেরার সময় গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালায় অনেকে। হাসপাতালে শুয়েই তাঁর অভিযোগ, ‘দূতাবাস থেকে কোনও সাহায্য পাইনি। প্রতিদিন বলা হচ্ছে, সাহায্য আসছে। কোথায় সাহায্য? আমি দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি। সেটা এভাবে নষ্ট করতে চাই না।’ যদিও এদিন রাতেই ভারতের বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, হরজ্যোতের চিকিৎসা খরচ দিচ্ছে সরকার। শীঘ্রই তাঁকে ফিরিয়ে আনা হবে। পাশাপাশি, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে নিরাপদে নাগরিকদের ফিরিয়ে আনতে দু’দেশের কাছে সংঘর্ষবিরতির আবেদন জানিয়েছে বিদেশ মন্ত্রক। মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি জানিয়েছেন, খারকিভ ও সুমিতে প্রায় এক হাজার ভারতীয় আটকে রয়েছেন। মোদি সরকারের কাছে দ্রুত পড়ুয়াদের ফিরিয়ে আনার আর্জি জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
তবে ফিরিয়ে আনা পড়ুয়াদের সামনে প্রধানমন্ত্রীর জয়গানে ঘাটতি নেই। এ ব্যাপারে পৌরোহিত্য করছেন বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরাই। বিমানের অন্দরমহল থেকে বিমানবন্দরের টারম্যাক—সর্বত্রই এক সুরে চলছে জয়গান। প্রধানমন্ত্রী নিজেও উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে তাঁর আমলে হওয়া উদ্ধার অভিযানের ঢালাও ফিরিস্তি দিয়েছেন। তবে তার মধ্যে বিতর্কও এড়াতে পারছেন না মন্ত্রীরা। ভি কে সিংয়ের পথ ধরেছেন এদিন আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরও। ইউক্রেন ফেরত বাংলার পড়ুয়াদের সঙ্গে দেখা করতে দিল্লির বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে বেরনোর পরই উদ্ধারকাজে মোদি সরকারের উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। উস্কে ওঠা ক্ষোভের প্রসঙ্গে তিনি হঠাৎই বলে ওঠেন, ‘এই ইস্যু নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরাই রাজনীতি করছেন।’