আন্তর্জাতিক

তৃতীয় মহাযুদ্ধ হবে কি? কি নির্দেশ দিচ্ছে বর্তমান ইউক্রেন-রাশিয়া পরিস্থিতি

ইউক্রেন সংকট শুরু হওয়ার সময় থেকেই বিশ্বের পণ্ডিতদের মধ্যে একটা গবেষণা শুরু হয়েছিল তৃতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলো কিনা। কারণ যুদ্ধটি যদিও বলা হয়েছে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে, আসলে যুদ্ধটা আমেরিকা তথা ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে। ন্যাটোর হাতে যেমন আণবিক মারণাস্ত্র আছে, তেমনি রাশিয়ার হাতেও আছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের মতো আহাম্মক নন। রাশিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং সামরিক শক্তির ভারসাম্য তৈরি করার পর পুতিন ইউক্রেনে হাত দিয়েছেন। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যতই হাঁকডাক করুন, দেশটি আক্রমণে সাহস করেননি।

কারণ উত্তর কোরিয়ার হাতেও আণবিক অস্ত্র আছে। তাই তিনি উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিমের সঙ্গে সিঙ্গাপুর বৈঠকে আপস করতে বাধ্য হয়েছেন। উত্তর কোরিয়া আক্রমণে সাহস করেননি। আফগানিস্তান থেকেও পরাজয়ের কলঙ্ক কপালে নিয়ে আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহারের চুক্তি করেছেন তিনি। আর প্রেসিডেন্ট বাইডেন তালেবানদের হাতে পূর্ণ ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েই আফগানিস্তান থেকে পলায়ন করেছেন।

ইউক্রেনে রাশিয়া প্রত্যক্ষভাবে হামলা চালায়নি। ন্যাটোর অস্ত্র, সেনাবাহিনী ইউক্রেনে মোতায়েন করে রাশিয়ার প্রতি একটি হুমকি তৈরি করেছিল। রাশিয়া সেই হুমকির জবাব দিয়েছে। এখন শান্তি আলোচনার নামে আমেরিকা মুখরক্ষার চেষ্টা করছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দুঘণ্টা ধরে টেলিফোনে আলাপ করেছেন এবং কাতর আবেদন জানিয়েছেন, চীন যেন রাশিয়াকে সাহায্য না করে। গত তিন দিন ধরে পশ্চিমা কাগজে আর যুদ্ধের খবর নেই। আছে ইউক্রেনে রাশিয়ার বর্বরতার খবর, যার অধিকাংশই বানানো। ইরাক যুদ্ধে যেমন মিথ্যা ও বানোয়াট খবর তৈরি করা হয়েছিল, ইউক্রেনেও তা করা হচ্ছে। আমেরিকা এখন যেটা করবে, তা হচ্ছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করা। তাতেও তারা সফল হবে, সেই সম্ভাবনা কম। ইরাক রাশিয়ার তুলনায় অনেক দুর্বল দেশ। তা সত্ত্বেও বারো বছর ধরে ইরাকের বিরুদ্ধে পশ্চিমা জগৎ অর্থনৈতিক অবরোধ চালিয়ে তাকে কাবু করতে পারেনি। এ ব্যর্থতার জন্যই তারা সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে ইরাক আক্রমণ করে এবং দেশটি ধ্বংস করে।

আফগানিস্তানে আমেরিকা তার সবচেয়ে কঠিন মারণাস্ত্রের হামলা চালিয়েছে। তালেবানরা আফগানিস্তানে কোনো সংগঠিত রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারেনি। তা-ও মার্কিন হামলা তারা ব্যর্থ করেছে। পুতিন এক্ষেত্রে সামরিক এবং অর্থনৈতিক দুক্ষেত্রেই রাশিয়াকে দুর্ভেদ্য করে তুলেছেন। পশ্চিমা জগৎ পঞ্চাশ বছর অর্থনৈতিক অবরোধ চালিয়েও রাশিয়াকে কাবু করতে পারবে না। নয়াচীনকেও এমনি করে তারা অর্থনৈতিক অবরোধ দ্বারা পরাজিত করতে চেয়েছিলেন। দেখা গেল নয়াচীন পরাজিত হয়নি। পরাজিত হয়েছে পশ্চিমা শক্তি। এ অর্থনৈতিক অবরোধ নাটকেও পশ্চিমাদের ভণ্ডামি লক্ষ করা যায়। পোল্যান্ড যখন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ছিল, তখন সেই দেশটির মাধ্যমে আমেরিকার বড় বড় পুঁজিপতিরা গোপনে চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। নিজেদের অর্থনৈতিক অবরোধ নিজেরাই ভঙ্গ করেছেন।

ইরানকে অবরোধ করতে গিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট রিগান তেহরানের সঙ্গে গোপনে অস্ত্র কেনাবেচা করায় ধরা পড়েন এবং তাকে ‘ইমপিচ’ করার দাবি উঠেছিল। তার বয়স বিবেচনা করে তাকে বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।

আমেরিকা লড়াই করে কোনো যুদ্ধে জিতেছে, তার কোনো প্রমাণ নেই। আমেরিকার অবস্থা অনেকটা কাবুলি ব্যবসায়ীদের মতো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সে যোগ দেয়নি। কেবল যুদ্ধ চালানোর জন্য ব্রিটেনকে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার ঋণ দিয়েছে। যখন বোঝা গেল, জার্মানি রাশিয়ার হাতে পরাজিত হতে যাচ্ছে, তখন আমেরিকা যুদ্ধে যোগদান করে যুদ্ধজয়ের গৌরব অর্জন করে! কোরিয়ার যুদ্ধেও আমেরিকা জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য দেশকে সম্মুখে পাঠিয়েছে। নিজে রয়েছে পেছনে। গালফ যুদ্ধেও তাই। ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশকে সামনে ঠেলে দিয়ে আমেরিকা পেছনে পেছনে যুদ্ধ করেছে। দেশগুলো ধ্বংস করেছে। যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আমেরিকা কাবুলিওয়ালার মতো ব্রিটেনকে এত ঋণ দিয়েছিল, যা ব্রিটেন আশির দশকে শেষ করে উঠতে পারেনি। এই ঋণের বোঝা-ই তাকে কাবুলিওয়ালার কাছে নতজানু করে রেখেছিল। লেবার, টোরি যে দল থেকেই প্রধানমন্ত্রী হন না কেন, তারা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে এই ঋণের চাপেই নতজানু থাকেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্রিটেন সফরে এসে বাকিংহাম প্রাসাদে রানি এলিজাবেথের প্রতি অশোভন আচরণ করলেও ব্রিটেন কিছু বলতে পারেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আমেরিকা এশিয়া ও আফ্রিকার ব্রিটিশ কলোনিগুলো একে একে দখল করতে থাকে। ব্রিটেনও হয়ে দাঁড়ায় আমেরিকার একটি নব্য উপনিবেশ। তা সত্ত্বেও মার্কিন সাম্রাজ্য পঞ্চাশ বছরও স্থায়ী হয়নি।

ইউক্রেন নিয়ে যদি যুদ্ধ হয়, তাহলে আমেরিকা ও রাশিয়া উভয় শক্তিই ধ্বংস হবে। কিন্তু আমেরিকার ক্ষতি হবে অবর্ণনীয়। আমেরিকা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও নয়াচীনকে ধ্বংস করার জন্য এ দুটি দেশকে বেষ্টন করে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে চায়। তাইপেতে তাদের সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে চীনকে ভয় দেখাবে। চীনা সমুদ্রে তাদের নৌবহর সাজিয়ে রাখবে এবং রাশিয়ার সাবেক অঙ্গরাজ্য যেমন ইউক্রেনে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে রাশিয়াকে দাবিয়ে রাখবে, এই পরিকল্পনা করেছিল। পুতিন সময়মতো ক্রিমিয়া দখলে নিয়ে এবং ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দিয়ে রাশিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। কিয়েভ যে ভুলটা করেছে, তা হলো মার্কিন নিয়ন্ত্রণে যাওয়া। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার পর যে চুক্তি ইউক্রেন করেছিল রাশিয়ার সঙ্গে, সেই চুক্তি অনুযায়ী তার নিরপেক্ষ থাকার কথা। এ চুক্তি অমান্য করে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে চেয়েছে এবং ন্যাটোর সেনাবাহিনীকে ডেকে এনেছে ইউক্রেনে। রাশিয়া এটা সহ্য করতে পারে না। তা ছাড়া পৃথিবীর প্রথম কমিউনিস্ট রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং সাবেক ইয়েলৎসিন সরকারের প্রতি আমেরিকা যেভাবে তাঁবেদারের মতো ব্যবহার করেছে, সেই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পুতিন সময় নিয়েছেন এবং প্রস্তুত হয়েছেন। তিনি রাশিয়ার গৌরব পুনরুদ্ধার করেছেন।

তৃতীয় মহাযুদ্ধ বা আণবিক যুদ্ধ হবে না। ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা শক্তির জন্য গৌরব বহন করবে না। সেখান থেকেও তাদের লজ্জাজনকভাবে সরে আসতে হবে। এখন যে যুদ্ধটা আবার শুরু হবে, তা কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক যুদ্ধ। কূটনৈতিকভাবে রাশিয়াকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলার এবং অর্থনৈতিক অবরোধ দ্বারা তার শক্তিকে পঙ্গু করার চেষ্টা আমেরিকা চালাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ অর্থনৈতিক যুদ্ধেও আমেরিকা জয়ী হবে কিনা। আমার বিশ্বাস, অর্থনৈতিক যুদ্ধেও পশ্চিমা শক্তি জয়ী হবে না।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ক্রমাগত যুদ্ধ করে করে মার্কিন অর্থনীতি এখন পঙ্গু। সাধারণ জিনিসপত্র থেকে শুরু করে সবকিছুই আমেরিকা তৈরি করে আনে চীন থেকে। এশিয়া ও আফ্রিকায় তার যে বিরাট বাজার, তা ধীরে ধীরে দখল করে নিয়েছে নয়াচীন। রাশিয়াও নয়াচীনের সঙ্গে সহযোগী হয়ে বিশ্বে সামরিক ও অর্থনৈতিক তৎপরতা বাড়াবে। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার হস্তক্ষেপেই আমেরিকা ইরান ও সিরিয়া আক্রমণ করতে পারেনি। গোটা ল্যাটিন আমেরিকা সমাজতন্ত্রকে তাদের রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছে। আমেরিকা চে গুয়েভারাকে হত্যা করেছে। কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি। ইউরোপ আমেরিকার সামরিক খবরদারি পছন্দ করে না। ফ্রান্স গোড়া থেকেই করত না। এখন আরও কয়েকটি দেশ ফ্রান্সের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।

ইউক্রেন নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর কোনো কারণ নেই। যুদ্ধে রাশিয়ার যা অভীষ্ট ছিল তা পূরণ হয়েছে। বাকিটা হয়তো পূরণ হবে শান্তি আলোচনার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের রাশিয়াবিরোধী, মার্কিনবিরোধী কোনো পক্ষ নেওয়ার সময় এটা নয়। তবে লক্ষ রাখতে হবে, তাতে যেন ভারতের সঙ্গে মৈত্রী ক্ষুণ্ন না হয়। ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অকাতরে সাহায্য করেছে। এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। এটা কম কথা নয়। চীন কারোরই পরীক্ষিত বন্ধু নয়। পাকিস্তানের বিপদের সময় তারা তার পাশে দাঁড়ায়নি। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া কোনো দেশের পাশে দাঁড়ায়নি। তার অর্থনৈতিক সাহায্যদানের নীতি আরও ভয়ানক। কোনো দেশের প্রজেক্টে বিপুল সুদের হারে চীন লোন দেয়। তারপর দেশটি সেই লোন ও তার সুদ দিতে না পারলে, প্রজেক্টসহ গোটা স্থানটি দখল করে নেয়। এভাবে চীন আফ্রো-এশিয়ার বহু দেশে উপনিবেশ স্থাপন করেছে। এদিক থেকে নয়াচীনকে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র না বলে একটি নব্য ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র বলা চলে।

Back to top button