আন্তর্জাতিক

ইউক্রেইনের সাথে যুদ্ধ করতে ঘাম ছুটছে রাশিয়ার, কী কী সামরিক ভুল করছে রাশিয়া!

বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ও শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী থাকার পরও ইউক্রেইনে হামলার পর থেকে এখন পর্যন্ত রাশিয়াকে অতটা শক্তিধর বলে মনে হচ্ছে না।

বিবিসি জানিয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে এ পর্যন্ত তাদের যা পারফরম্যান্স, তা পশ্চিমা অনেক সমর বিশ্লেষককেই হতবাক করছে; একজন তো একে ‘হতাশাজনক’ বলেও অভিহিত করেছেন।

রাশিয়ার বাহিনীর অগ্রগতি এখন অনেকটাই যেন থমকে আছে। যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাদের, সেখান থেকে তারা সামলে উঠতে পারবে কি না, কেউ কেউ তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন।

কয়েকদিন আগে নেটোর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছিলেন, “এটা স্পষ্ট যে রাশিয়ানরা তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি, সম্ভবত শেষ পর্যন্তও পারবে না।”

কেন এমনটা হল? কোথায় ভুল করলো তারা?

বিবিসির এক প্রতিবেদক ঊর্ধ্বতন পশ্চিমা সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সেই ভুলগুলোই চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন।

ভ্রান্ত ধারণা

রাশিয়ার প্রথম ভুল হচ্ছে তারা ইউক্রেইনের তুলনামূলক ছোট সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা ও প্রতিরোধের শক্তিকে খাটো করে দেখেছিল।

রাশিয়ার বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট ৬ হাজার কোটি ডলারের বেশি; পক্ষান্তরে ইউক্রেইন খরচ করে ৪০০ কোটি ডলারের সামান্য বেশি।

ইউক্রেইনের প্রতিরোধ সক্ষমতা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণার পাশাপাশি রাশিয়া এবং আরও অনেকেই মস্কোর সামরিক শক্তিকে অতিরিক্ত বড় করে দেখছিলেন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে উচ্চাভিলাষী কর্মসূচি নিয়েছিলেন এবং সম্ভবত তিনি তার নিজের বাগাড়ম্বরকে বিশ্বাসও করে বসেছিলেন।

যুক্তরাজ্যের ঊর্ধ্বতন এক সামরিক কর্মকর্তা জানান, সামরিক বাহিনীতে রাশিয়ার বিনিয়োগের বড় অংশই খরচ হয় হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের মতো নতুন অত্যাধুনিক অস্ত্রের সাহায্যে পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে এবং এসব অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষায়।
রাশিয়ার টি-১৪ আর্মাটাকে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ট্যাংক বলেও মনে করা হয়; মস্কোর রেড স্কয়ারে ভিক্টরি ডে’র এক কুচকাওয়াজে সেটি দেখানোও হয়েছিল, অথচ যুদ্ধক্ষেত্রে ওই ট্যাংকের টিকিটিরও দেখা মিলছে না।

ইউক্রেইনে এখন পর্যন্ত রাশিয়া যেসব যুদ্ধ সরঞ্জাম ব্যবহার করেছে, তার মধ্যে আছে পুরনো টি-৭২ ট্যাংক, আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি), কামান ও রকেট লঞ্চার।

হামলার শুরুতে আকাশযুদ্ধে রাশিয়াকেই এগিয়ে রাখা হয়েছিল; তারা সীমান্তের কাছে ইউক্রেইনের তিনগুণেরও বেশি জঙ্গিবিমান জড়ো করেছিল।

অনেক সমর বিশ্লেষকেরই অনুমান ছিল, রুশরা দ্রুত ইউক্রেইনের আকাশের দখল নিয়ে নেবে, কিন্তু সেটা হয়নি। ইউক্রেইনের বিমান প্রতিরক্ষাকে এখনও অনেকটাই কার্যকর মনে হচ্ছে, যা যুদ্ধে রাশিয়ার দ্রুত অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দিচ্ছে।

সম্ভবত মস্কোর ধারণা ছিল, তাদের বিশেষ বাহিনী যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে ও দ্রুত ফলাফল এনে দেবে।

পশ্চিমা এক ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তার মতে, রাশিয়া ভেবেছিল তারা স্পেৎসনাৎজ ও ভিডিভি ছত্রীসেনাদের মতো হালকা, অগ্রবর্তী ইউনিট মোতায়েন করে ‘সামান্য সংখ্যক প্রতিরোধকারীকে শেষ করে দেবে এবং সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে।’

কিন্তু অভিযানের প্রথম কয়েকদিন কিইভের বাইরের হস্তোমেল বিমানবন্দরে তাদের হেলিকপ্টার হামলা বারবার প্রতিহত হয়েছে; যে কারণে রাশিয়া আকাশপথে সেনা, সরঞ্জাম ও রসদ সেখানে নিয়ে আসতে পারেনি। এর বদলে তাদেরকে সড়কপথে রসদ পাঠাতে হচ্ছে। যা দীর্ঘসূত্রিতার জন্ম দিচ্ছে; কিছু কিছু পয়েন্টে ইউক্রেইনীয় বাহিনীর অতর্কিত হামলার মুখেও পড়েছে।

কিছু ভারী সাঁজোয়া যান সড়ক থেকে সরে যাওয়ায় কাদায় আটকে পড়েছে।

উপগ্রহের চিত্রে ধরা পড়া উত্তর দিক থেকে আসা রাশিয়া দীর্ঘ সামরিক বহর এখন পর্যন্ত কিইভকে ঘেরাও করতে পারেনি। রুশ বাহিনীর বেশি অগ্রগতি হয়েছে দক্ষিণে, কেননা সেখানে তারা রেল লাইন ব্যবহার করে সেনাদের রসদ পাঠাতে পারছে।

সব মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিনের বাহিনী ‘মোমেন্টাম হারিয়ে ফেলেছে’ বলে ধারণা যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেসের।
“তারা আটকে পড়েছে, আস্তে আস্তে হলেও তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে যাচ্ছে,” বলেছেন তিনি।

ক্ষয়ক্ষতি ও মনোবল হারিয়ে ফেলা

ইউক্রেইনে এই হামলা চালানোর জন্য রাশিয়া প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার সেনা জড়ো করেছিল, যার বেশিরভাগ অংশ এখন যুদ্ধেই। কিন্তু এরই মধ্যে মস্কো তাদের মোতায়েন করা সৈন্যের ১০ শতাংশের মতো হারিয়ে ফেলেছে।

রাশিয়া ও ইউক্রেইনের পক্ষে কার কত হতাহত, সে সম্বন্ধে এখন পর্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য কোনো সংখ্যা পাওয়া যায়নি। ইউক্রেইনের দাবি, তারা তিন সপ্তাহেই ১৪ হাজার রুশ সেনাকে হত্যা করেছে; তাদের এই ভাষ্য যুক্তরাষ্ট্রও বিশ্বাস করছে না। ওয়াশিংটনের অনুমান, রাশিয়া এখন পর্যন্ত ৭ হাজারের মতো সেনা হারাতে পারে।

পশ্চিমা কর্মকর্তারা রুশ সেনাদের ভগ্ন মনোবলের প্রমাণ পাওয়ার কথাও বলছেন। একজনের ভাষ্য, যুদ্ধরত রুশ বাহিনীর মনোবল এখন ‘খুব, খুব কম’। অন্য একজন বলেছেন, আক্রমণকারী সেনারা ‘ঠাণ্ডায় কাতর, ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত’, কেননা হামলার সবুজ সংকেত পাওয়ার আগে কয়েক সপ্তাহ ধরে তারা বেলারুশে আর রাশিয়ায় তুষারের মধ্যে অপেক্ষা করছিল।

ক্ষয়ক্ষতি পূরণে রাশিয়াকে এখন বাধ্য হয়ে আরও সেনা খুঁজতে হচ্ছে; দেশের পূর্ব প্রান্ত ও আর্মেনিয়া থেকে রিজার্ভ ইউনিটগুলোকে ডাকতে হচ্ছে।

পশ্চিমা কর্মকর্তাদের অনুমান, গোপন ওয়াগনার গোষ্ঠীর ভাড়াটে সেনাদের পাশাপাশি সিরিয়ার বিদেশি সেনারাও শিগগিরই ই্উক্রেইনের যুদ্ধে যোগ দিতে যাচ্ছে।

রসদ ও সরঞ্জাম

মৌলিক কিছু বিষয় নিয়েও ভুগছে রাশিয়া। পুরনো একটি সামরিক প্রবাদে বলা হতো, নবিসরা কথা বলে কৌশল নিয়ে, পেশাদাররা হিসাব করে সরঞ্জাম। রাশিয়া যে এদিকে খুব বেশি মনোযোগ দেয়নি, তথ্যপ্রমাণ তা-ই বলছে।

তাদের সাঁজোয়া বহরে জ্বালানি, খাদ্য ও গুলির সংকট দেখা দিয়েছে। যানবাহন ভেঙে পড়ায় সেগুলো রেখেই এগোতে হয়েছে।

রাশিয়া হয়তো যুদ্ধে ব্যবহারের মতো ক্ষেপণাস্ত্র সংকটেও ভুগছে, ধারণা পশ্চিমা কর্মকর্তাদের।

মস্কোকে এরইমধ্যে ক্রুজসহ দূরপাল্লার মূল্যবান সাড়ে আটশ থেকে নয়শ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে হয়েছে; অন্য গোলার তুলনায় এগুলো প্রতিস্থাপন করা বেশ শক্ত। এ ঘাটতি পূরণে রাশিয়া চীনের কাছে হাত পাততে পারে, এমন উদ্বেগও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের।

উল্টোদিকে ইউক্রেইন বাহিনীর কাছে পাশ্চিমাদের পাঠানো অস্ত্রের একের পর এক চালান যাচ্ছে, যা কিইভের সেনাদের মনোবলও চাঙা করে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে আরও ৮০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, তাদের এবারের প্রতিশ্রুত অস্ত্রের মধ্যে ট্যাংক ও বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি ছোট সহজে বহনযো্গ্য ‘কিলার’ ড্রোনও আছে, যা যুদ্ধক্ষেত্রে ছোটখাট বিস্ফোরকও নিয়ে যেতে পারবে।

পশ্চিমা কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলছেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন এখন ‘আরও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে হামলার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারেন’। তার কাছে এখনও এত অস্ত্র রয়েছে যে তিনি ইউক্রেইনের শহরগুলোতে লম্বা দিন ধরে বোমাবর্ষণ করে যেতে পারবেন।

“বিপত্তি সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট পুতিনের পিছু হটার সম্ভাবনা কম এবং সম্ভবত তিনি হামলার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেবেন। তিনি সম্ভবত আত্মবিশ্বাসী যে রাশিয়া সামরিকভাবে ইউক্রেইনকে পরাস্ত করতে পারবে,” বলেছেন এক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

ইউক্রেইনের বাহিনী এখন পর্যন্ত তীব্র প্রতিরোধ দেখাতে সক্ষম হলেও রসদ ও সরঞ্জামের উল্লেখযোগ্য সরবরাহ না থাকলে তাদের পক্ষেও রুশ বাহিনীর সামনে টিকে থাকা সম্ভব হবে না, বলেছেন তিনি।

সমর বিশ্লেষকরাও বলছেন, যুদ্ধের শুরুর দিকের তুলনায় ইউক্রেইনীয় বাহিনীর সফল হওয়ার সম্ভাবনা হয়তো বেড়েছে, কিন্তু এখনও তাদের পাহাড় টপকাতে হবে।

Back to top button