ব্রিটিশ আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রত্যাহার করে নতুন আইন আনার প্রস্তাব দিয়েছে ভারত সরকার। প্রস্তাবিত আইনে রাষ্ট্রদ্রোহের সংজ্ঞা যেমন চলতি আইনের চেয়ে অনেকটা প্রসারিত হচ্ছে তেমনই ন্যূনতম সাজার মেয়াদ বৃদ্ধিরও প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু যে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনেই পরিবর্তন আনার কথা বলা হচ্ছে, তা নয়। ভারতের ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়াতেও পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে। সংসদে এ সংক্রান্ত বিল পেশ করা হয়েছে।
তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহ সংক্রান্ত আইন পরিবর্তন নিয়ে। চলতি রাষ্ট্রদ্রোহ দমন আইনের কারণে বাক-স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল। সরকার এমন যুক্তি দেখালেও আইনজীবীরা মনে করছেন প্রস্তাবিত আইনে সেই স্বাধীনতা আরও খর্ব হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। তাদের মতে, প্রস্তাবিত রাষ্ট্রদ্রোহ আইন আরও কঠোর হচ্ছে।
চলতি রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের যে অপব্যবহার হচ্ছে, সেটা একাধিক মামলার রায়ে উঠে এসেছে। এই আইনের যে পরিবর্তন দরকার, সেটা কেন্দ্রীয় সরকারও সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়া এক হলফনামায় জানিয়েছিল। তারপরেই গতবছর ভারতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানার নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চের নির্দেশে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে দায়ের করা সব বিচারাধীন মামলা, আপিল এবং সব আইনি প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হয়েছে। ওই আইনটি পুনর্বিবেচনা করবে সরকার। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে চলতি রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে নতুন মামলা দায়ের করা থেকেও বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের ওই বেঞ্চ।
রাষ্ট্রদ্রোহ আইন নিয়ে আলোচনা চলতে থাকলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই সংসদের বাদল অধিবেশনের শেষ দিনে তিনটি বিল পেশ করেন। যার মাধ্যমে ইন্ডিয়ান পেনাল কোড বা আইপিসি, ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড বা সিআরপিসি এবং ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট- এই তিনটি আইনের বদলে নতুন তিনটি আইন আনার কথা বলা হয়েছে।
অমিত শাহের পেশ করা বিল অনুযায়ী, ভারতীয় দণ্ডবিধির নাম বদলে এবার সেটা হতে চলেছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোডের নাম হবে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা আর ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্টের প্রস্তাবিত নতুন নাম হবে ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম।
ফৌজদারি মামলার বিচার প্রক্রিয়া, সাক্ষ্য গ্রহণ আর সাজার মেয়াদ সবই নির্ভর করে আইপিসি, সিআরপিসি আর এভিডেন্স অ্যাক্টের ওপর। নতুন নামে আইনগুলি আনার জন্য বিলটি পেশ করার পরেই সিলেক্ট কমিটিতে পাঠিয়ে দিয়েছে সরকার। এতে বিস্তারিত আলোচনার পর সেটা আবার পার্লামেন্টে ফিরিয়ে আনা যায়।
বর্তমানে ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১২৪ ধারাটি এত বছর ধরে ভারতে ‘দেশদ্রোহ’ বা রাষ্ট্রদোহ’-এর মতো অপরাধের বিচার ও সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে আইন পরিবর্তনের স্বপক্ষে বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, যেসব আইন প্রত্যাহার করা হচ্ছে সেগুলো ব্রিটিশ প্রশাসনকে রক্ষা আর শক্তিশালী করার জন্য ব্যবহৃত হতো। মূল ধারণাটা ছিল শাস্তি দেওয়ার, ন্যায় বিচার নয়। ওই আইনগুলো বদলে যে তিনটি নতুন আইন আনা হচ্ছে, তার মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত করার কথাই ভাবা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, লক্ষ্যটা শাস্তি দেওয়া নয়, ন্যায় বিচার করা। অপরাধ বন্ধ করার প্রবণতা গড়ে তোলার জন্য সাজা দেওয়া হবে। ব্রিটিশ আমলের যেসব আইন প্রত্যাহার করে নতুন আইনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহ দমন আইনে পরিবর্তন নিয়ে।
প্রস্তাবিত নতুন আইনে রাষ্ট্রদ্রোহের বিষয়টি রয়েছে ন্যায় সংহিতার ১৫০ নম্বর ধারায়। চলতি আইনে রাষ্ট্রদ্রোহের যে সংজ্ঞা রয়েছে, প্রস্তাবিত আইনে সংজ্ঞাটি দীর্ঘতর হয়েছে। এখানে রাষ্ট্রদ্রোহের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি জেনেশুনে মুখে বা লিখে, অথবা কোনও আকার-ইঙ্গিতে বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কিংবা অর্থনৈতিক ভাবে অথবা যেকোনও ভাবে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করে বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজকর্ম, সশস্ত্র বিদ্রোহ বা অন্তর্ঘাতমূলক কোনো কাজ করলে, যা ভারতের একতা, সার্বভৌমত্ব বা অখণ্ডতার জন্য বিপদ হয়ে উঠতে পারে এরকম অপরাধের ক্ষেত্রে কমপক্ষে সাত বছর আর সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন জেলের সাজার কথা বলা হয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনে রাষ্ট্রদ্রোহের সংজ্ঞায় যে শব্দগুলো যোগ করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা, সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং অন্তর্ঘাতমূলক কাজ। বর্তমানে যে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন চালু আছে, তাতেও যাবজ্জীবন বা তিন বছরের সাজার কথা রয়েছে, সঙ্গে জরিমানাও হতে পারে অপরাধীর।
চলতি রাষ্ট্রদ্রোহ আইন অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন কলকাতার মানবাধিকার কর্মী প্রসূন চ্যাটার্জী। তার বিরুদ্ধে মাওবাদীদের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ ছিল। ১০ বছর কারাবাসের পরে তিনি বেকসুর খালাস পেয়েছেন।
প্রসূন চ্যাটার্জী বলেন, নতুন আইনের ব্যাপারে যতটুকু পড়লাম, তাতে আমাকে যে আইনে সাজা দেওয়া হয়েছিল, সেখানে কমপক্ষে তিন বছরের সাজার কথা ছিল। এখানে সেটা সাত বছর করা হয়েছে। সঙ্গে জরিমানার সাজাও আছে, যেমনটা বর্তমান আইনেও রয়েছে। যাবজ্জীবন সাজা আগের আইনেও ছিল, যেটা আমাকে দেওয়া হয়েছিল আর প্রস্তাবিত আইনেও সর্বোচ্চ সাজা সেটাই রয়েছে।
তিনি বলেন, এটা অনেকটা তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়ার মতো বিষয়। প্রসূন চ্যাটার্জী আরও বলেন, চলতি রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের যেসব ধারা রয়েছে, সেটা প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা বলা হলেও সন্ত্রাস দমন আইন বা ইউএপিএ-তে সবগুলো ধারাই কার্যকর রয়েছে। সেখানে কোনো পরিবর্তনের কথা বলা হয়নি।
বর্তমান চালু আইপিসি অনুযায়ী, যিনি রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনছেন তাকেই অভিযোগ প্রমাণ করতে হয় কিন্তু সন্ত্রাস দমন আইনে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের দায় অভিযুক্তের ওপরেই বর্তায় বলে জানান মানবাধিকার কর্মী প্রসূন চ্যাটার্জী। সংসদ সদস্য এবং সুপ্রিম কোর্ট ও কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, বলা হচ্ছে যে দেশদ্রোহ আইনটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু আদৌ সেটা নয়। উল্টো আরও মারাত্মক আইন করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী সরকারের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন, কোনো প্রতিবাদ করা যাবে না। সবকিছুই চলে আসবে দেশদ্রোহের আওতায়।
মানবাধিকার কর্মী, হাইকোর্ট এবং সর্বোচ্চ আদালত অনেকদিন ধরেই ব্রিটিশ আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন পুনর্বিবেচনার কথা বলে আসছে।মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করে যে বর্তমানে যে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন আছে, তার ব্যাপক অপপ্রয়োগ করা হয় সরকার বিরোধীদের ওপর।
ইন্ডিয়ান পেনাল কোড বা আইপিসি যখন ১৮৬০ সালে আইনে পরিণত হয় সেখানে রাষ্ট্রদ্রোহের বিষয়টি ছিল না। আইপিসিতে একটি সংশোধনী এনে ১৮৭০ সালে রাষ্ট্রদ্রোহ যুক্ত করা হয়। এই আইনটি ১৮৪৮ সালের ইংলিশ ট্রিজন ফেলনি অ্যাক্ট অনুসারে তৈরি করা হয় যেন ভিন্নমত পোষণকারী, বিদ্রোহী কার্যকলাপ মোকাবিলা করা যায়।
ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হতো। তবে স্বাধীনতার পরেও এই আইনের প্রয়োগ চলতে থাকে, আবার বিভিন্ন আদালতে সরকার পক্ষকে রাষ্টদ্রোহিতার মামলা দেওয়ার জন্য সমালোচিতও হতে হয়েছে। অনলাইন পোর্টাল ‘আর্টিকেল ১৪’ তাদের এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে যে, ২০১০ সাল থেকে আটশোটি রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ১৩ হাজার মানুষের বিরুদ্ধে।
আবার জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে রাষ্ট্রদ্রোহের ৪৭টি মামলা হয়েছিল। এর পাঁচ বছর পর ২০১৯ সালে ৯৩টি মামলা দায়ের করা হয়। যদিও বিচারের পরে সাজা হয়েছে মাত্র তিন শতাংশ মামলায়। সাম্প্রতিক সময়ে যাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, ছাত্র নেতা, মুসলিম অধিকার কর্মীসহ এমন ব্যক্তিরা রয়েছেন, যারা সরকারের নানা নীতি বা কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।