বিশেষ: টাইটানিকের চারপাশে যে কারণে এখনো লুকিয়ে আছে বিপদ, জেনেনিন মূল সেই কারণ
আটলান্টিক সাগরে বরফ খণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে আরএমএস টাইটানিক জাহাজের ডুবে যাওয়ার ঘটনা সবারই জানা। ১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল ছোট হয়ে ১২৫ মিটার হওয়া আইসবার্গটির সঙ্গে ধাক্কা লেগে প্রথম সমুদ্রযাত্রাতেই ডুবে যায় সেই সময়ের দীর্ঘতম এই জাহাজটি। মাত্র তিনঘণ্টার মধ্যে বিশাল জাহাজটি তলিয়ে যায় জলে।
এ দুর্ঘটনায় জাহাজের দেড় হাজারের বেশি যাত্রী ও ক্রুর মৃত্যু হয়। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ এখন নিউফাউন্ডল্যান্ড উপকূল থেকে প্রায় ৬৪০ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে মোটামুটি সাড়ে ১২ হাজার ফুট (৩.৮ কিলোমিটার) গভীর সমুদ্রে পড়ে আছে।
আটলান্টিকে ভেসে বেড়ানো আইসবার্গগুলো এখনো জাহাজের জন্য ঝুঁকির সৃষ্টি করে। কিন্তু সমুদ্রের গভীরে সমাধিস্ত টাইটানিকের চারপাশে আরো অন্যান্য বিপদও লুকিয়ে আছে। যার অর্থে হলো বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শনে যাওয়াও একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ। সাবমেরিনে করে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়ে পাঁচ ব্যক্তি নিখোঁজ হওয়ার পর সমুদ্র তলদেশের এই অঞ্চলটি কেমন তা ব্যাখ্যা করেছে বিবিসি।
গভীর সমুদ্রে চলাচল
গভীর সমুদ্র পুরোপুরি অন্ধকার থাকে। কারণ সূর্যের আলো এক হাজার মিটারের বেশি গভীরে প্রবেশে অক্ষম। এর পরে সাগরে আর কিছু দেখা যায় না। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষও এরকম ‘মিডনাইট জোন’ নামে পরিচিত অঞ্চলে রয়েছে।
আগের অভিযানের যাত্রীদের বর্ণনায়, ধ্বংসস্তূপের জায়গায় সাবমেরিনের লাইটের আলোয় সমুদ্রের তলদেশ দেখা যাওয়ার আগ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অন্ধকারের মধ্য দিয়ে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলে এটি। এ সময় গভীর সমুদ্রে চলাচল করা চ্যালেঞ্জিং এবং পথ ভুল করার আশঙ্কাও বেশি থাকে।
কয়েক দশক ধরে করা উচ্চ রেজ্যলুশন স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের বিশদ মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া সোনার পদ্ধতির মাধ্যমে অন্ধকারে বিভিন্ন বস্তু শনাক্ত করতে পারে ক্রুরা।
পাশাপাশি সাবমেরিনের পাইলটেরা ‘ইনার্শিয়াল নেভিগেশন’ নামক একটি কৌশলের ওপরও ভরসা করেন। এ পদ্ধতিতে যাত্রা শুরুর জায়গা থেকে গতি হিসেব করার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানা যায়। টাইটান সাবমেরিনেও অত্যাধুনিক ইনার্শিয়াল নেভিগেশন সিস্টেম থাকে, যা সমুদ্রের গভীরতা এবং সাবমেরিনের গতি অনুমান করতে ডপলার ভেলোসিটি লগ নামক পরিচিত একটি অ্যাকোস্টিক সেন্সরের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
তা সত্ত্বেও আগের যাত্রীরা সমুদ্রের তলদেশে পৌঁছানোর পর পথ খুঁজে পাওয়া কতটা কঠিন সে বর্ণনা দিয়েছেন। গত বছর ওশোনগেট-এর সাবমেরিনে চড়ে অভিযানে যাওয়া টিভি কমেডি লেখক মাইক রেইস বলেন, ‘তলদেশে পৌঁছানোর পরও আপনি বুঝবেন না কোথায় আছেন। টাইটানিক হয়তো আশেপাশেই আছে। তবে সেখানে এতই অন্ধকার যে, সুমদ্রের নিচে থাকা সবচেয়ে বড় জিনিসটি ৫০০ গজ দূরে থাকা সত্ত্বেও আমাদের খুঁজে পেতে সময় লেগেছিল ৯০ মিনিট।’
গভীর সমুদ্রে তীব্র চাপ
কোনো বস্তু সমুদ্রের যত গভীরে যায়, তার চারপাশের জলের চাপ তত বাড়তে থাকে। সমুদ্রতলে ১২ হাজার ৫০০ ফুট জলের নিচে টাইটানিক এবং তার চারপাশের সবকিছু প্রায় ৪০ মেগাপ্যাসকেল (এমপিএ) চাপ সহ্য করে, যা পৃষ্ঠের তুলনায় ৩৯০ গুণ বেশি।
স্টকহোম ইউনিভার্সিটির সমুদ্র গবেষক রবার্ট ব্লাসিয়াক বলেন, সেখানে জলের চাপ একটি গাড়ির টায়ারের চাপের প্রায় ২০০ গুণ বেশি। তাই সেখানে যেতে এমন সাবমেরিন দরকার যার দেহকাঠামো অনেক পুরু।
কার্বন ফাইবার এবং টাইটানিয়াম দিয়ে তৈরি ওশেনগেটে সাবমেরিনের কাঠামো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যা চার হাজার মিটার গভীরতায় টিকে থাকতে সক্ষম।
নিচের স্রোত
সমুদ্রের উপরিভাগের স্রোতের তাণ্ডব সম্পর্কে আমরা সকলেই পরিচিত। পৃষ্ঠের মতো এতটা শক্তিশালী না হলেও গভীর সমুদ্রেও স্রোত আছে। এ স্রোতও প্রচুর জল প্রবাহিত করতে পারে।
এছাড়া সমুদ্রের এ অঞ্চলে বেন্থিক ঝড় নামক পরিচিত একটি ঝড় দেখা যায় — এ ঘটনা অবশ্য খুবই বিরল। এ ঝড় এমন স্রোত তৈরিতে সক্ষম যা তলদেশে থাকা বস্তুকে জায়গা থেকে সরিয়ে দিতে পারে।
সম্প্রতি উচ্চ রেজ্যলুশন স্ক্যানিং প্রক্রিয়ায় টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ স্ক্যান করার জন্য একটি অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গভীর সামুদ্রিক প্রত্নতাত্ত্বিক গেরহার্ড সেফার্ট। তিনি বলেন, ঐ অঞ্চলের স্রোত সাবমেরিনের জন্য কোনো ঝুঁকি তৈরি করবে তা তিনি বিশ্বাস করেন না।
সেফার্ট বলেন, এসব স্রোত নিখুঁত ম্যাপিংয়ের জন্য সমস্যা তৈরি করে তবে গভীর সমুদ্রের জলযানের জন্য হুমকি তৈরি করার মতো ততটা শক্তিশালী নয়।
ধ্বংসাবশেষ নিজেই
সমুদ্রের তলদেশে ১০০ বছরের বেশি সময় পরে, টাইটানিক ধীরে ধীরে আরো ক্ষয় হচ্ছে। জাহাজের দুটি প্রধান অংশ সমুদ্রের তলদেশে ধাক্কা খাওয়ার পরই বড় অংশগুলো বিকৃত হয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে, লোহা নষ্ট করা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসাবশেষকে দ্রুত নষ্ট করছে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, জাহাজের সামনের অংশের চেয়ে পেছনের অংশ দ্রুত নষ্ট হচ্ছে।
সেফার্ট বলেন, প্রধানত ক্ষয়ের কারণে প্রতি বছর একটু একটু করে ধসে পড়ছে অবশিষ্ট অংশগুলো। কিন্তু যতক্ষণ আপনি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখবেন ততক্ষণ কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
প্রবাহিত পলি
সমুদ্রের তলদেশে হঠাৎ পলির প্রবাহ অতীতে সমুদ্রের তলদেশে মানবসৃষ্ট বস্তু নষ্ট করেছে তার প্রমাণ আছে। এমনকি সেগুলো সরিয়ে নিয়ে গেছে জায়গা থেকে। পলি প্রবাহের সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে ১৯২৯ সালে। সে বছর ভূমিকম্পের মতো ঘটনার কারণে আটলান্টিকের তলদেশ দিয়ে নেয়া ক্যাবল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
টাইটান সাবমেরিন নিখোঁজ হওয়ার সাথে এই ধরনের ঘটনা ঘটার কোনো ইঙ্গিত নেই। তবে নিখোঁজের ঘটনা অবশ্যই নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
গবেষকেরা জানান, টাইটানিক ধ্বংসাবশেষের চারপাশের তলদেশে সুদূর অতীতে বড় ধরনের ভূমিধসের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
নিউফাউন্ডল্যান্ড থেকে কন্টিনেন্টাল স্লোপে (সমুদ্রের নির্দিষ্ট গভীরতা) বিপুল পলির স্তরকে বিজ্ঞানীরা ‘ইন্সট্যাবিলিটি করিডর’ বলে অভিহিত করেছেন। ধারণা করা হয় এমন ধ্বংসাত্মক ঘটনা কয়েক হাজার বছর আগে ঘটেছিল। তখন ১০০ মিটার পুরু পলির স্তর তৈরি হয়েছিল।
টাইটানিকের চারপাশে সমুদ্র তল নিয়ে দীর্ঘ সময় অধ্যয়ন করা কানাডার সামুদ্রিক ভূতত্ত্ব গবেষণা বিজ্ঞানী ডেভিড পাইপার এ ধরনের ঘটনাকে ভিসুভিয়াস বা মাউন্ট ফুজির অগ্ন্যুৎপাতের সাথে তুলনা করেন। অর্থাৎ প্রতি দশ হাজার থেকে কয়েক হাজার বছরে এমন ঘটনা ঘটে। তবে ঝড়ের কারণে কন্টিনেন্টল স্লোপে পলি ও জল প্রবাহিত হতে পারে। পাইপার বলেন, প্রতি ৫০০ বছরে এমন কিছু ঘটে। তবে এমন পলি প্রবাহ টাইটানিকের ধ্বংসস্তুপ পর্যন্ত পৌঁছাবে না।
সেফার্ট এবং পাইপার দুজনই টাইটান নিখোঁজ হওয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনা ভূমিকা রেখেছে এমন সম্ভাবনা কম বলে মন্তব্য করেছেন।
ধ্বংসাবশেষের চারপাশে আরো ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো এখনো অন্বেষণ করা বাকি। ফরাসি নৌবাহিনীর সাবেক ডাইভার পল-হেনরি নারজিওলেট তার ১৯৯৬ সালের অভিযানে সোনারে একটি রহস্যময় আলো (ব্লিপ) দেখতে পান। পরে দেখা যায় সেটা একটি পাথুরে প্রাচীর।
নিখোঁজ সাবমেরিনের অনুসন্ধান অব্যাহত থাকলেও, সেখানের যাত্রী কিংবা ক্রুর কপালে কী ঘটেছে সে বিষয়ে খুব কমই অনুমান করা যাচ্ছে। তবে এমন একটি চ্যালেঞ্জিং এবং অপ্রত্যাশিত পরিবেশে, টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শনের ঝুঁকিগুলো এখনো ১৯৮৬ সালের মতো প্রাসঙ্গিক। সে বছর প্রথমবারের মতো ডুবে যাওয়া টাইটানিকে চোখ রাখে মানুষ।
সূত্র : বিবিসি, টিবিএস