বিশেষ: গুপ্তচর থেকে রাশিয়ার সুপারহিরো ভ্লাদিমির পুতিন, জেনেনিন তার জীবনকাহিনী
ভ্লাদিমির পুতিন নামটি সভ্যজগতের প্রতিটি মানুষেরই জানা। তাঁকে আমরা চিনি রাশিয়ার দোর্দন্ড প্রতাপ প্রেসিডেন্ট হিসেবে। ইসরায়েল, আমেরিকাকে টেক্কা দিয়ে চলার মত বর্তমান পৃথিবীতে বোধহয় এই একজন মানুষই রয়েছেন। কিন্তু এসবের বাইরে আসলে তিনি মানুষ হিসেবে কেমন? তাঁর পারিবারিক জীবন, ছেলেবেলা কেমন ছিল – ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের খুব বেশি জানা নেই।
জানা বিষয়গুলোকে আরও ভালভাবে জানা, এবং না জানা বিষয়গুলোকে জানার জন্যই আজকের এই লেখার অবতারনা।
ভেবে দেখুন তো যদি জেমস বন্ড বা মাসুদ রানা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে নেমে কোনও দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হয়ে বসলেন – তাহলে কেমন হবে? – স্বপ্ন মনে হচ্ছে? রাশিয়ার মানুষের কাছে কিন্তু ব্যাপারটি স্বপ্ন নয় – সেই ১৯৯৯ সাল থেকে তারা এই স্বপ্নের মাঝেই বসবাস করছে। কারণ তাঁদের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন একজন বাস্তব জীবনের একজন জেমস বন্ড বা মাসুদ রানা। কেজিবির অন্যতম একজন সেরা সিক্রেট এজেন্ট হিসেবে অবসর নিয়ে নব্বইয়ের দশকে তিনি রাজনীতিতে নামেন – এবং অল্প কিছুদিনের ব্যবধানেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট তো হনই, পুরো বিশ্বের নিয়ন্ত্রণের একটি বড় অংশ নিজের অধিকারে নিয়ে নেন।
শৈশব:
বড় হওয়ার সমস্ত গুন ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট নিয়ে জন্মালেও শৈশবে পুতিন ছিলেন মারাত্মক দুষ্টু ও পড়াশুনায় অমনযোগী। বাল্যকালে তাঁকে রীতিমত একপ্রকার লাগাম পরিয়ে রাখতে হত। কিন্তু একটি উপলব্ধিই তাঁর মাঝে বিরাট এক পরিবর্তন এনে দেয় যা ছিল এক ঐতিহাসিক যাত্রার প্রথম ধাপ। চলুন একে একে আমরা সেই যাত্রার ধাপগুলো ঘুরে আসি।
young valdimir putin
নিজের বেড়ে ওঠার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পুতিন একবার বলেছিলেন – “আমি খুব সাধারন একটি পরিবার থেকে এসেছি। (একটি সাধারন পরিবারের সন্তান হিসেবেই) আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছি। আমি নিজেও একজন স্বাভাবিক সাধারন মানুষের মত জীবন কাটিয়েছি – এবং সব সময়েই সেই বিষয়টা বজায়ে রেখেছি।”
ভ্লাদিমির ‘ভ্লাদিমিরোভিচ’ পুতিন ১৯৫২ সালের ৭ই অক্টোবর তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের লেলিনগ্রাদে খুবই সাধারন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
পুতিনের মা মারিয়া শিলোমোভা অসম্ভর রকমের দয়ালু এবং নরম মনের একজন মানুষ ছিলেন। মায়ের রান্না বিষয়ে পুতিনের ভাষ্য – “আমরা খুবই সাধারন ভাবে থাকতাম। (আমাদের খাদ্যতালিকায় ছিল) বাঁধাকপির স্যুপ, কাটলেট এবং প্যানকেক। তবে রবিবার ও উত্সবের দিনে আমার মা বাঁধাকপি, মাংস এবং চালের সমন্বয়ে খুবই সুস্বাদু স্টাফড বন (পিরোজকি) তৈরী করতেন, সাথে থাকতো কাস্টার্ড।”
অনেকেই জানেন যে সাবেক কেজিবি এজেন্ট পুতিন একজন জুডো ব্লাকবেল্ট। এই জুডো প্রশিক্ষণ তিনি কিশোর বয়স থেকেই শুরু করেছিলেন এবং মারিয়া প্রথমদিকে ছেলের এই ‘মারামারি’ অনুশীলন করাটা মোটেও পছন্দ করতেন না। সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পুতিন একবার বলেছিলেন – “যখনই আমি জুটো প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে বের হতাম মা গজগজ করে বলতেন ‘ঐযে, আমার ছেলে আবারও মারামারি করতে চলল’- অবশ্য আমার জুডো কোচ যেদিন আমার বাসায় এসে আমার বাবা-মাকে বললেন (জুডো শেখার ফলে) তিনি কি করেছেন এবং কি অর্জন করেছেন – এরপরেই সব বদলে যায়। আমার এই ‘খেলার’ প্রতি আমার পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল।”
ভ্লাদিমির পুতিনের বাবা ভ্লাদিমির পুতিন প্রথম জীবনে একজন যোদ্ধা ছিলেন। ১৯৫০ এর দশকে – যখন পুতিনের জন্ম হয় তখন তিনি একজন সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কাজ করতেন, পরবর্তীতে তিনি পরিবহন ক্ষেত্রে একজন ফোরম্যান হিসেবে কাজ করেন। পুতিনের ভাষ্যমতে – “আমার বাবা ১৯১১ সালে সেইন্ট পিটার্সবার্গে জন্মগ্রহণ করেন। ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সেইন্ট পিটার্সবার্গে খাদ্যের অভাব দেখা দিল এবং এবং সেখানে বসবাস করাও কঠিন হয়ে পড়ল। সেই কারনে (আমার বাবার) পুরো পরিবার রাশিয়ার টিভের এর পোমিনোভো গ্রামে স্থানান্তরিত হল, যা ছিল আমার দাদীর পৈতৃক গ্রাম। মজার ব্যাপার হলো আমার আত্মীয়স্বজনেরা আমার দাদা-দাদীর বাড়িতে এখনও অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে যায়। পমিনোভোতেই আমার বাবা মায়ের দেখা হয় এবং ১৭ বছর বয়সে তাঁরা বিয়ে করেন।”
স্কুলজীবন:
স্কুলজীবনের অনেকটা সময় ভ্লাদিমিরের তকমা ছিল: “ক্লাসের দুষ্টু ছেলে”
১৯৬০ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ভ্লাদিমির লেলিনগ্রাদের স্থানীয় একটি প্রাইমারি স্কুল এর ছাত্র ছিলেন। অষ্টম শ্রেণী পাশ করার পর তিনি প্রাইমারী ছেড়ে হাইস্কুলে ভর্তি হন। হাইস্কুলটি ছিল রসায়ন বিদ্যায় বিশেষ প্রাধান্য দেয়া একটি প্রযুক্তি শিক্ষাকেন্দ্র। ১৯৭০ সালে পুতিন এখান থেকে পাশ করে বের হন।
তবে স্কুলে ভর্তি হওয়ার বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত পুতিন ভাল ছাত্রের থেকে “দুষ্টু ছেলে” হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তাঁর নিজের কথা অনুযায়ী – “আমি প্রথম ক্লাসে বরাবরই দেরিতে পৌঁছাতাম। এমনকি শীতের দিনেও আমি ঠিকঠাক ভাবে স্কুলড্রেসে আসতে পারতাম না।”
তবে এই দুষ্টু ছেলের মাঝে সম্ভাবনার বিজ দেখতে পেরেছিলেন একজন শিক্ষক ভেরা গুরিভিচ। প্রিয় ছাত্রের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গুরিভিচ বলেছিলেন – “সে যখন পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্র, যদিও সে তখনও নিজেকে চিনতে পারেনি, কিন্তু আমি তার ভেতরে সম্ভাবনা, শক্তি আর ভাল একটি চরিত্র দেখতে পেয়েছিলাম। আমি ওর ভেতরে ভাষার বিষয়ে দারুন আগ্রহ দেখেছিলাম। সে খুব সহজেই সবকিছু ধরতে পারত। ওর ছিল দারুন স্মৃতিশক্তি এবং ক্ষিপ্র বুদ্ধি। আমার মনেহয়েছিল এই ছেলে দারুন কিছু করবে, কাজেই আমি ওর প্রতি আরও মনযোগী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, রাস্তার ছেলেদের কাছ থেকে ওকে যথা সম্ভব সরিয়ে রাখার ব্যাপারে মনযোগী হলাম।”
পরিবর্তন:
৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পুতিন লেখাপড়ার প্রতি তেমন একটা আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর শিক্ষক ভেরা বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি চাইলে অনেক ভাল করতে পারবেন এবং অনেক ভাল গ্রেড পাওয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব।
ভেরা পুতিনের বাবা পুতিন সিনিয়রের সাথে দেখা করে তাঁর ছেলের ওপর প্রভাব খাটাতে বললেন। সেটা খুব বেশি কাজে না লাগলেও ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে হঠাত্ করে পুতিন নিজে থেকেই লেখাপড়ার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠতে লাগলেন। পুতিনের কথা অনুযায়ী – “অন্যান্য জরুরী বিষয় আমার সামনে দেখা দিতে লাগল। আমি খেলাধুলার মধ্য দিয়ে কিছু অর্জন করে নিজেকে (এতদিন) পরিমাপ করছিলাম। কিন্তু আমি আরও নতুন নতুন উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে শুরু করলাম, এবং (আমার ওপর) এর প্রভাব ছিল বিশাল।”
ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময়ে ভ্লাদিমির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তাঁকে জীবনে বড় কিছু অর্জন করতে হবে, এরপর থেকেই তিনি ভাল ফলাফল করতে শুরু করলেন, যা তাঁর জন্য বেশ সহজই ছিল। তিনি “ইয়ং পাইওনিয়ার্স অর্গানাইজেশানে” যোগ দেয়ার সুযোগও করে নিলেন – যা আমাদের দেশের স্কাউটের মত একটি সংগঠন। এই সংগঠনে যোগ দেয়ার প্রায় সাথে সাথেই তিনি তাঁর সমবয়সী পাইওনিয়ারদের নেতা বনে যান।
সেই সময়ে তাঁর মনোভাবের বিষয়ে পুতিন বলেন – “আমার কাছে এই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে সাধারণ ভাল ছাত্র হওয়াটা (বড় হওয়ার জন্য) যথেষ্ঠ নয়, কাজেই আমি খেলাধুলায় অংশ নিতে শুরু করলাম। কিন্তু সেটাও আমার মর্যাদাকে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ঠ মনে হলো না, আমি বলছি লম্বা সময়ের কথা। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার পড়াশুনাতেও ভাল করতে হবে।”
উচ্চশিক্ষা: (লেলিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেজিবি স্কুল):
স্পাইদের জীবন ঠিক যেন এ্যাকশান সিনেমার নায়কদের মত। জীবন হাতে নিয়ে প্রতিনিয়ত দেশের সেবা করে যাওয়া। দেশের বিরুদ্ধে শত্রুদের সব চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দেয়া। স্পাই অথবা গুপ্তচরদের দারুন সব কীর্তির কাহিনী পুতিনকে ছোটবেলাতেই দারুন আকর্ষণ করেছিল।
স্কুল শেষ করার আগেই পুতিন ঠিক করে ফেলেন যে তিনি ইন্টেলিজেন্স এর হয়ে কাজ করবেন। হাইস্কুলে পড়ার সময়ে তিনি কেজিবির একটি শাখার পাবলিক রিসিপশনে গিয়ে জেনে আসেন কিভাবে একজন স্পাই বা গুপ্তচর হওয়া যায়। তিনি জানতে পারেন হয় তাকে সেনাবাহিনীতে কাজ করতে হবে, অথবা তাঁর একটি কলেজ ডিগ্রি থাকতে হবে, সবথেকে ভাল হয় যদি সেই ডিগ্রিটি হয় আইনের ওপর। এই প্রসঙ্গে পুতিনের ভাষ্য ছিল – “সেই মূহুর্ত (কেজিবিতে খোঁজ নেয়ার মূহুর্ত) থেকে আমি লেলিনগ্রাদ স্টেট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগে ঢোকার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দেই।”
১৯৭০ সালে ভ্লাদিমির লেলিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। তাঁর শ্রেণীতে ১০০ জন শিক্ষার্থী ছিল এবং পুতিন সহ মাত্র দশজন ছিল সবেমাত্র হাইস্কুল পাশ করা ছাত্র। বাকি সবাই মিলিটারি সার্ভিস শেষ করে এসেছিল। এই ১০টি আসনের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিল ৪০০ জন শিক্ষার্থী। পুতিন শুধু রচনায় পাঁচের মধ্যে চার পাওয়া ছাড়া বাকি সবগুলো বিষয়ে সর্বোচ্চ মার্ক পেয়ে পাশ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করার পরে নিজের মনোভাব ব্যক্ত করতে গিয়ে পুতিন বলেন – “আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করলাম আমার সামনে নতুন উদ্দেশ্য এবং আমার মাঝে নতুন ভাবনার জন্ম হলো। আমি পড়াশুনাকে আরও বেশি গূরুত্ব দিতে শুরু করলাম এবং খেলাধুলার বিষয়টা দ্বিতীয় পছন্দের বিষয়ে পরিনত হলো। তবে আমি নিয়মিতই আমার প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছিলাম, এবং, অনেকটা অভ্যাসের বশেই, দেশজুড়ে প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করতাম।”
কর্মজীবন শুরু:
একজন গুপ্তচর হিসেবে দেশের সেবা করার স্বপ্ন পূরণ করতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পরপরই পুতিন যোগ দেন রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থায়। পরিচালকের সহকারী হিসেবে ইন্টেলিজেন্সে তাঁর কাজের শুরু হয়। পরবর্তীতে তিনি কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এ বদলী হন। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স শাখায় তিনি পাঁচ মাসের মত কাজ করেন। ইন্টেলিজেন্সে কাজ করার প্রায় ছয় মাসের মাথায় তাঁকে বেশ কয়েকটি অপারেশন এবং পুঃন প্রশিক্ষণ কোর্স করতে পাঠানো হয়। তারপর তিনি আবার কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সে ফিরে আসেন এবং আরও ছয় মাস সেই বিভাগে কাজ করেন।
কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এ দ্বিতীয় মেয়াদে কাজ করার সময়ে তিনি ফরেন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁকে বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য মস্কোতে পাঠানো হয়। সেখানে এক বছর কাটানোর পর তিনি লেলিনগ্রাদে ফিরে যান, সেখানকার প্রধান কেজিবি শাখায় তিনি প্রায় সাড়ে চার বছর কাজ করেন।
এরপর তিনি আবার মস্কোতে ফিরে যান এবং “Andropov Red Banner Institute (যা “কেজিবি স্কুল নম্বর ওয়ান” নামেও পরিচিত)”এ তাঁর জার্মানি অভিযানের জন্য প্রশিক্ষণ নেন।
ভ্লাদিমির পুতিন এর বিয়ে:
পুতিনের মত একজন গম্ভীর ও শক্ত ব্যক্তিত্বের মানুষ প্রেমে পড়েছিলেন এটা ভাবতে একটু কষ্ট হলেও তিনি আশির দশকের শুরুর দিকে লুডমিলা নামের এক তরুণীর প্রেমে পড়েছিলেন।
পুতিন তাঁর একজন বন্ধুর মাধ্যমে লুডমিলা স্কেরিবেনভার সাথে পরিচিত হন। লুডমিলা সরকারি এয়ার লাইনের একজন ফ্লাইট এ্যাটেন্ডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং এক বন্ধুর সাথে তিন দিনের জন্য লেলিনগ্রাদে বেড়াতে এসেছিলেন।
লুডমিলার সাথে পরিচয় এবং প্রণয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পুতিন বলেছিলেন -“আমি তখন সেইন্ট পিটার্সবার্গে কেজিবির প্রধান শাখায় কাজ করছিলাম। আমার এক বন্ধু আমাকে ফোন দিয়ে আরকাডে রাইকিন থিয়েটারে (Arkady Raikin theatre) আমন্ত্রণ জানায়। সে আমাকে বলে সে আগেই টিকেট কিনে রেখেছে এবং আমাদের সাথে দুইজন তরুণীও থাকবে।”
“আমরা নাটক দেখতে গেলাম এবং সেই তরুণীরাও আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিল। পরের দিন আমরা আবার থিয়েটারে গেলাম এবং সেদিন আমি নিজেই টিকেট কিনেছিলাম। তৃতীয় দিনও সেই একই ঘটনা ঘটল। এরপর আমি দুই তরুণীর একজনের সাথে ডেট করা শুরু করলাম। আমি আমার ভবিষ্যত্ স্ত্রী লুডমিলার সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়লাম।”
পুতিনের সাথে তাঁর প্রেমের কথা স্মরণ করতে গিয়ে লুডমিলা বলেন “ভ্লাদিমিরের মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল যা আমাকে আকর্ষণ করেছিল। তিন-চার মাসের মধ্যেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম এই লোকটিকে আমার প্রয়োজন।”
লুডমিলা তিন-চার মাসের মধ্যে বুঝে গেলেও পরিচয়ের তিন বছরের মাথায় পুতিন লুডমিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। “আমি জানতাম যদি আমি আর দুই কি তিন বছরের মধ্যে বিয়ে না করি তাহলে হয়তো আর কোনওদিনই করা হবে না। আমিব্যাচেলর জীবনে সত্যিই বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু লুডমিলা আমার জীবনে আসার পর সেটা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল।” ১৯৮৩ সালের ২৮ জুলাই পুতিন ও লুডমিলা বিয়ে করেন। ২০১৩ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে তাঁদের ত্রিশ বছরের দাম্পত্যের ইতি ঘটে।
সন্তান:
বিয়ের দুই বছর পর ১৯৮৫ সালে ভ্লাদিমির ও লুডমিলার বড় মেয়ে মারিয়ার জন্ম হয়। পরের বছরই তাঁদের দ্বিতীয় মেয়ে ক্যাটরিনা জন্মগ্রহণ করে। ক্যাটরিনার জন্ম হয় জার্মানির ডিসডেনে।
পুতিনের দুই কন্যার নামই তাদের তাদের দাদী ও নানীর সম্মানে রাখা। মারিয়া (পুতিনের মা) ইক্যাটরিনা (লুডমিলার মা)।
মারিয়া ও ক্যাটরিনার মায়ের কথা অনুযায়ী পুতিন তাঁর মেয়েদের অতিরিক্ত ভালবাসেন। তাঁর ভাষ্য – “সব বাবা তাঁর (পুতিনের) মত করে নিজের সন্তানদের ভালবাসতে পারেন না। সে সবসময়ে মেয়েদের ছাড় দেয়; আমাকেই সবসময়ে ওদের শাসনে রাখতে হয়েছে।”
জার্মানি অধ্যায়:
১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ – এই পাঁচ বছর পুতিন রাশিয়ান এজেন্ট হিসেবে পূর্ব জার্মানিতে কাজ করেন। জার্মানিতে কাজ করাকালীন তিনি পদন্নোতি পেয়ে প্রথমে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল এবং পরি আবারও পদন্নোতি পেয়ে বিভাগীয় প্রধানের প্রধান সহকারী হন। ১৯৮৯ সালে জার্মান রিপাবলিকে কাজ করা রাশিয়ান এজেন্টদের জন্য প্রদেয় মেডেল ও সম্মাননায় ভূষিত হন “ন্যাশনাল পিপলস্ আর্মি”‘ এর প্রতি তাঁর নিঃসার্থ সেবার পুরস্কার হিসেবে।
এই প্রসঙ্গে পুতিনের কথা- “আমার কাজ আশাতীত ভাবে ভাল চলছিল। বাইরে কাজ করার সময়ে একবার পদন্নোতি পাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু আমি দুইবার পদন্নোতি পেয়েছিলাম!”
নব্বই এর দশক:
১৯৯০ সালে পুতিন জার্মানিতে তাঁর কাজ শেষ করে লেলিনগ্রাদে ফিরে আসেন। সেখানে তিনি লেলিনগ্রাদ স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকের সহকারী হিসেবে কাজে যোগ দেন। এই পদে তাঁর দায়িত্ব ছিল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পরিচালককে সহায়তা করা। এই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পুতিন বলেছিলেন – “আমি লেলিনগ্রাদ স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের সুযোগ পেয়ে খুবই খুশি ছিলাম। কাজটিতে যোগদান করার সময় আমার আশা ছিল যে সেখানে বসে আমি আমার পি.এইচ.ডি থিসিসটি লিখে শেষ করব এবং হয়তো সেখানেই থেকে গিয়ে কাজ করে যাব। ১৯৯০ সালে আমার লক্ষ্য ছিল সেটাই, পরিচালকের সহকারী হিসেবে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো দেখা।”
বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর দ্রুতই তিনি লেলিনগ্রাদ সিটি কাউন্সিল এর সভাপতির বিশেষ উপদেষ্টাও বনে যান।
১৯৯১ সালের জুনে সেইন্ট পিটার্সবার্গ সিটি হল এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন; এবং ১৯৯৪ সাল থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ সিটি গভর্মেন্টের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান।
সিটি হল এ কাজ শুরু করার সময়ে তিনি কেজিবিতে তাঁর পদত্যাগ পত্র পাঠান।
মস্কো ও প্রধানমন্ত্রীত্ব:
জাতীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রশাসনের সহকারী প্রধান হওয়ার প্রস্তাব পেয়ে ১৯৯৬ সালে পুতিন তাঁর পরিবারের সাথে মস্কোতে চলে যান।
এরপর থেকে তাঁর ক্যারিয়ার রকেটের গতিতে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে একই সাথে রাষ্ট্রপতির প্রশাসনিক অফিসের সহকারী চিফ অব স্টাফ এবং প্রধান নিয়ন্ত্রক দপ্তরের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকার পরও তিনি অর্থনীতিতে তাঁর ডক্টরেট থিসিসের কাজ করার জন্যও সময় বের করে তার পেছনেও সময় দিতে থাকেন। ১৯৯৮ সালের মে মাসে তিনি রাষ্ট্রপতির প্রশাসনিক দপ্তরের প্রধান চিফ অব স্টাফ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন এবং সেই বছরের জুলাইয়েই তিনি ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৯৯ সালের মার্চ থেকে তিনি রাশিয়ান ফেডারেশানের নিরাপত্তা বিষয়ক কাউন্সিলের সচিব হিসেবে আসীন হন।
সেই বছরেরই আগস্ট মাসে তিনি রাশিয়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। রাশিয়ার তত্কালীন রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলত্সীন নিজে থেকে পুতিনকে এই পদে আসীন হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন। পুতিনের নিজের ভাষ্য অনুযায়ী – “জনাব ইয়েলত্সীন আমাকে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য ডেকে পাঠান এবং আমাকে প্রধানমন্ত্রীর পদটি নেয়ার জন্য প্রস্তাব করেন। তিনি সেই কথপোকথনে একবারের জন্যেও ‘উত্তরসুরী’ কথাটি ব্যবহার করেননি কিন্তু ‘সম্ভাবনাময় একজন প্রধানমন্ত্রী’ হওয়ার ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন সবকিছু ঠিক থাকলে এটা (প্রধানমন্ত্রী হওয়া) খুবই সম্ভব।”
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে তখনকার ভাবনাকে তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন – “আমার সেই সময়ের চিন্তা ছিল, আমি যদি এর মধ্য দিয়ে এক বছর ভালভাবে টিঁকে যেতে পারি সেটাই হবে একটা ভাল শুরু। আমি যদি রাশিয়াকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কিছু করতে পারি তা অবশ্যই গর্বিত হওয়ার মত কিছু হবে।”
রাশিয়ান ফেডারেশানের আপত্কালীন রাষ্ট্রপতি হলেন ভ্লাদিমির পুতিন:
২০০০ সালের নববর্ষ উদযাপনের অল্প আগে রাশিয়ার তত্কালীন রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলত্সীন পুতিনকে আরও একবার ডেকে পাঠিয়ে তাঁকে আপত্কালীন রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব দেন।
পুতিন সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন -“নববর্ষের দুই সপ্তাহ আগে জনাব ইয়েলত্সীন আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে নিয়ে জানান যে তিনি পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যার মানে ছিল আমাকে আপত্কালীন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করতে হবে।”
রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি হওয়াকে “অনেক গুরু একটি দায়িত্ব” বিবেচনা করে পুতিন সেটিকে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেন। রাশিয়ার রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করার আগে তাঁর মনে কি চিন্তা চলছিল সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পুতিন বলেছিলেন – “(প্রেসিডেন্ট এর পদ গ্রহণ করার ব্যাপারে) আমার নিজস্ব চিন্তা ছিল, সেইসাথে ছিল নিজের ভেতরে দ্বন্দ। কিন্তু আরও একটি ব্যাপার আমাকে বিবেচনা করতে হয়েছিল : নিয়তি আমাকে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আমার দেশের সেবা করার সুযোগ এনে দিয়েছিল, এবং না করাটা ছিল বড় এক বোকামি। আমি চেয়েছিলাম একটা সময়ে গিয়ে আমি সূর্যমুখীর বিজের ব্যবসা করব, অথবা ব্যক্তিগত ভাবে আইনের ব্যবসা করব, কিন্তু (আমার মনে হয়েছিল) এসব আমি পরেও করতে পারব। কাজেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে আগে এটা (রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন) করতে হবে, এরপর বাকি সবকিছু।”
১৯৯৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পুতিন রাশিয়ার আপত্কালীন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি:
আপত্কালীন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেয়ার অল্প পরেই পুতিন ২০০০ সালের ২৬শে মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবির্ভূত হন। সেই বছরের ৭ই মে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তাঁর শপথ গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া প্রথম ভাষণে তিনি বলেন – “আমাদের সবার লক্ষ্য এক। আমরা সবাই চাই রাশিয়া একটি মুক্ত, উন্নত, প্রাচূর্যময়, শক্তিশালী এবং সভ্য দেশ হোক। এমন একটি দেশ যা নিয়ে এর নাগরিকরা গর্ব করবে এবং যে দেশ সারা বিশ্বের সম্মান অর্জন করবে। হয়তোবা সবসময়ে ভুলকে পাশ কাটানো সম্ভব হবে না। কিন্তু আমি যা প্রতিজ্ঞা করতে পারি, এবং আমি প্রতিজ্ঞা করছিও যে আমি সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাব।”
দ্বিতীয় মেয়াদে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী:
প্রথম মেয়াদে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দারুন সফলতা ও সাধারন রাশিয়ানদের মাঝে দারুন জনপ্রিয়তা অর্জন করার পর ২০০৪ সালের ৪ মার্চ পুতিন আবারও রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালের ৮ মে পুতিন দ্বিতীয়বারের মত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান।
পুতিনের মতে জনগনই একজন প্রধানমন্ত্রীর মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত্। প্রশাসনকে অবশ্যই জনগনের সমর্থন অর্জন করতে হবে। যদি সেই সমর্থন তারা না পান, তাহলে ক্ষমতায় থাকার কোনও অধিকারই তাদের নেই। পুতিনের এই মনোভাব ধারন করা এবং সেই মনোভাবকে কাজে পরিনত করার কারনেই রাশিয়ার সাধারন মানুষের মাঝে তাঁর এতটা জনপ্রিয়তা।
২০১০ সালে দাবানলে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষজনের ঘরবাড়ি পূনর্নিমান কাজের দেখভাল পুতিন স্বপ্রনোদিত হয়ে গ্রহণ করেন। যেসব স্থানে ঘরবাড়ি নির্মানের কাজ হচ্ছিল, সেখানে ২৪ ঘন্টা সিসি ক্যামেরা চালু ছিল। ক্যামেরার ফুটেজ সরাসরি পুতিনের অফিসে ও বাসায় বসে দেখার ব্যবস্থা তো ছিলই, যে কেউ ইচ্ছে করলেই সরকারী ওয়েবসাইটে ঢুকে কাজের অগ্রগতি সরাসরি দেখতে পারত। দাবানলের আগুনে নিহতদের প্রতিটি পরিবার সরকারের পক্ষ থেকে দশ লাখ রাশিয়ান রুবল্ অর্থসাহায্য পেয়েছিল সেই সাথে দাবানলে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সকল সদস্য মাথাপিছু এক লক্ষ রুবল্ করে পেয়েছিল। গ্রীষ্মে লাগা দাবানলে ক্ষতিগ্রস্থ প্রতিটি পরিবার যারা গৃহহারা হয়েছিল – সবাইকে শীত আসার পূর্বেই নতুন বাড়ি বা এ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর করা হয়। অথবা যারা অনুরোধ করেছিল, বাড়ির বদলে তাদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। সর্বমোট ২২০০টি পরিবার এই ক্ষতিপূরণ প্রকল্পের আওতায় নতুন বাড়ি লাভ করেছিল।
রাশিয়ার কৃষিক্ষেত্র উন্নয়নে পুতিন সব সময়েই সরাসরি সমর্থন দিয়ে এসেছেন। তাঁর মতে ধাপে ধাপে রাশিয়া নিজেদের খাদ্য এবং কৃষির স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করছে। তিনি কৃষিক্ষেত্রে জড়িতদের সব সময়েই অন্যরকম উত্সাহ দিয়ে থাকেন।
২০১১ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর পুতিন ঘোষণা করেন যে ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের মধ্যে শিক্ষকদের বেতন অন্তত প্রতিটি এলাকার অর্থনীতি অনুযায়ী সর্বোচ্চ বেতন গড়ের সমান হতে হবে। এই ব্যাপারটি তিনি ব্যক্তিগত ভাবে তদারক করেন।
এছাড়াও তিনি ২০১৩ সালের মধ্যে সেনাসদস্যদের পেনশনের হার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি এবং তাদের বেতন ভাতার পরিমান বাড়ানোরও নির্দেশ দেন প্রশাসনকে।
২০১১ সালের নভেম্বরে পুতিন আবারও রাশিয়ার টুয়েলভথ্ পার্টি কনগ্রেস থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মনোনয়ন পান। ২০১২ সালের মার্চে তিনি আবারও রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম দেশ এবং এর ইতিহাস রক্তাক্ত ও বেদনাপূর্ণ। এক শতাব্দীর মধ্যেই এই দেশটি রাজতন্ত্রের পতন দেখেছে, দেখেছে সমাজতন্ত্রের উত্থান ও পতন, বিশ্বযুদ্ধের আঘাত সরাসরি এই দেশটিকে ক্ষতবিক্ষত করেছে, ত্রিশের দশকের ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা প্রত্যক্ষ করেছে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে দেখেছে। পুতিনের ক্ষমতাগ্রহণের আগ পর্যন্ত রাশিয়া একটি ভঙ্গুর দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত ছিল। পুতিন দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে রাশিয়াকে নিজ হাতে গড়েছেন। জনগনের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করেছেন, রাশিয়ার ভাবমূর্তি ও সম্মান বিশ্বমঞ্চে পুনুরুদ্ধার করেছেন। রাশিয়া ও নিজেকে আবারও বিশ্বের একটি অন্যতম সুপারপাওয়ারে পরিনত করেছেন। অনেকের মতেই সাম্প্রতিক কালে পুতিনের মত করে রাশিয়াকে আর কেউ বোঝেনি বা সেই অনুযায়ী চালাতেও পারেনি। তেল, গ্যাস, তামা এবং এ্যালুমিনিয়ামের মত প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর সঠিক ব্যবহার পুতিন নিজ দায়িত্বে নিশ্চিত করেছেন। স্পাই হিসেবে নিজের সাবেক কাজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি রাশিয়ান ইন্টেলিজেন্সকে ঢেলে সাজিয়েছেন।
একজন কেজিবি গুপ্তচর, যাকে একটা সময়ে কেউই চিনত না, নব্বই এর দশকে এসে তিনিই হয়ে উঠলেন রাশিয়ার সবথেকে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। দেশের অভ্যন্তরে ভ্লাদিমির পুতিনের গ্রহনযোগ্যতার রেটিং ৮৬ শতাংশ, যেখানে আমেরিকার একজন রাষ্ট্রপতি ৫০ এর ঘর ছুঁতে পারলেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। একজন বিচক্ষণ ও জনপ্রিয় নেতার পাশাপাশি তিনি নিজেকে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত একজন তারকায় পরিনত করেছেন। সিনেমার নায়কের মতই তাঁর খালি গায়ে ঘোড়ায় চড়ার ছবি বিশ্বব্যাপী ভাইরাল হয়েছে, তিনি ডুবুরি হয়ে সমুদ্রের নিচে প্রাচীন শহরের সন্ধান করেন, কৃষ্ণ সাগরের তলদেশে নিজেই সাবমেরিন চালিয়ে অভিযান চালান – ইত্যাদি ইত্যাদি। জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়বে জেনেও মুদ্রাস্ফিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিনি সবার জন্য খরচের সীমা বেঁধে দিয়ে দেশের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন।
পরিশিষ্ট:
পশ্চিমা মিডিয়াগুলো যদিও তাঁর দুর্নাম গাইতেই বেশি পছন্দ করে, কারন পুতিন তাদের একচেটিয়া আধিপত্যে ভাগ বসাচ্ছেন । কিন্তু দেশের জনগনের কাছে তিনি হিরো। তাঁদের মতে পুতিন রাশিয়াকে তাদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে দিয়েছেন, আরও একবার দেশটিকে পরিনত করেছেন পরাক্রমশালী এক সুপারপাওয়ারে। মিইয়ে পড়া রাশিয়ার আন্তর্জাতিক প্রভাবকে আরও একবার শক্তিশালী করে বিশ্বশক্তিকে পশ্চিমাকেন্দ্রিক করনের গতিতে লাগাম পরিয়ে দিয়েছেন। রাশিয়ার সাধারন জনগনের আশা, পুতিনের হাত ধরেই রাশিয়া আরও একবার বিশ্বশাসন করবে।