বিশেষ: বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে ভারতের কত টাকা খরচ হয়েছে?- জেনেনিন সেই হিসেব

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, বিকেল ৪টা বেজে ৩১ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিলেন পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজি। ভারতের পরাক্রমের সামনে ৯৩ হাজার পাক সেনা বিনা শর্তে অস্ত্র নামিয়ে রেখেছিল। বিশ্বের ইতিহাসে এত বড় আত্মসমর্পণের নজির আর নেই। পূর্ণতা পেয়েছিল শেখ মুজিবের ‘জয় বাংলা’ আন্দোলন। ঢাকা ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে পিছু হটেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা। দীর্ঘ ২৩ বছরের শৃঙ্খল ভেঙে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
এই ইতিহাস অনেকেরই জানা। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্ব ও জেনারেল স্যাম মানেক’ শ-এর সুযোগ্য পরিচালনায় ভারতীয় সেনাবাহিনী কিভাবে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করেছিল, তাও অনেকেরই অবগত। কিন্তু অনেকেই হয়তো ভুলে গেছেন, শুধু সামরিক সাহায্য নয়, স্বাধীনতা অর্জনে ও তার পরবর্তীকালে বাংলাদেশকে অকাতরে অর্থ সাহায্যও করেছে ভারত। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র কেনা থেকে শুরু করে নতুন রাষ্ট্রের পরিকাঠামো নির্মাণ পর্যন্ত, ভারত যতটা আর্থিক সহায়তা দিয়েছে, বিশ্বের ইতিহাসে তেমন নজির বিরল।
প্রথমেই আসা যাক মুক্তিযুদ্ধের খরচের হিসাবে। ভারত মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের সেনার জন্য আর্থিক সাহায্য, প্রশিক্ষণ ও খাদ্যসামগ্রীর জন্য তৎকালীন হিসাবে ১৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে, যার বেশিরভাগটাই ছিল নগদ অর্থ। এছাড়াও, প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধার জন্য অন্তত ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পাঠিয়েছিল ভারত।
শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলায় ভারতের খরচও ছিল বিপুল। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় ৩ কোটি মানুষ ঘরছাড়া হন, যাদের মধ্যে অন্তত ১ কোটি ভারতে আশ্রয় নেন। সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবার থেকে শুরু করে সেনা অফিসার, পুলিশ, পুরোহিত, শিক্ষক, শিল্পী—সবাই ছিলেন সেই তালিকায়। শুরুতে প্রতিদিন প্রায় ১৭ হাজার এবং শেষের দিকে প্রতিদিন অন্তত ৬০ হাজার উদ্বাস্তু ভারতে আশ্রয় নিতে আসেন। ভারত তাঁদের খাবার, আশ্রয় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১-এর এপ্রিল থেকে ১৯৭২-এর মার্চ মাস পর্যন্ত প্রায় ৯০ লক্ষ থেকে ১ কোটি শরণার্থীকে খাদ্য ও আশ্রয় দিতে ভারতের খরচ হয় ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আজকের হিসাবে ৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৪৭ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। এই বিপুল অর্থ ভারত তার নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করেছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আর্থিক সাহায্য অব্যাহত রেখেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল ভারত। মার্কিন গোয়েন্দা নথি অনুযায়ী, ভারত স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশকে ১৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক সাহায্য করে, যার মধ্যে ৩২ মিলিয়ন ডলার ছিল নগদ অর্থ। এছাড়াও, ঢাকাতে ৩৪ মিলিয়ন ডলারের শিশুদের দুধ, চিনি, নুন ও ওষুধ পাঠিয়েছিল দিল্লি, যা আজকের হিসাবে প্রায় ১১ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। শুধু নগদ অর্থ নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে প্রচুর খাদ্যসামগ্রীও পাঠিয়েছিল দিল্লি এবং তাদের ব্যাংকগুলিকে স্বনির্ভর হতে সফট লোন দেয় ভারত। ভারতের উদ্যোগেই বিশ্বের অন্তত ৯৫টি দেশ বাংলাদেশের অস্তিত্ব জানতে পেরে আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ধীরে ধীরে ঘরছাড়াদের বাংলাদেশে ফিরতেও সাহায্য করে দিল্লি।
১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে মোট ১২২.৪৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থসাহায্য পেয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ২০১০ সালে পরিকাঠামোর উন্নয়ন ও জঙ্গিদমনের জন্য ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এলওসি (লাইন অফ ক্রেডিট) এবং ২০১৭ সালে ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এলওসি। ২০১৬ সাল থেকে রাস্তা, রেলপথ ও বন্দর নির্মাণের জন্য ভারত অন্তত ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে, যার মধ্যে খুলনা-মঙ্গলা বন্দর রেল লাইন ও আখাউরা-আগরতলা রেল লিঙ্ক অন্যতম। এমনকি, ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষেও বাংলাদেশকে ১২০ কোটি টাকার বার্ষিক আর্থিক সাহায্য প্রদান করেছে ভারত। সবমিলিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য ভারত প্রায় ৬.৫ থেকে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে, যার মধ্যে ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার শরণার্থী সমস্যার মোকাবিলায় এবং ৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিভিন্ন লাইন অফ ক্রেডিটের জন্য। টাকার অঙ্কে এই সংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ ৯৯ হাজার ২৬৩০ কোটি টাকা।
তবে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সাহায্যকে শুধু টাকার অঙ্কে বিচার করলে চলবে না। দেশটির স্বাধীনতা থেকে শুরু করে একটি সদ্য গঠিত রাষ্ট্রের ভিত্তি পর্যন্ত—পুরোটাই ভারতের নিঃস্বার্থ সাহায্যে নির্মিত। আজ অবশ্য চিন, আমেরিকা, জাপান ও বিশ্বব্যাংকও বাংলাদেশকে গভীরভাবে আর্থিক সাহায্য করে।