অফবিট

বিশেষ: ব্যারিস্টারি পড়া শেষ না হতেই, যে কারণে বিলেত ছাড়তে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে

জমিদার পুত্র হলে কী? প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় কোনো মন ছিল না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জমিদারের সন্তান যদি লেখাপড়া না করে, তবে প্রজারা শিখবে কী? তাছাড়া, জমিদারিটা ঠিকভাবে টিকিয়ে রাখতে গেলেও তো লেখাপড়া করে নিজেকে যোগ্য-দক্ষ করে তুলতে হবে। এসব ভেবেই রবীন্দ্রনাথের পারিবার উচ্চশিক্ষার জন্য তাকে বিলেতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। এই প্রথম শুরু হয় রবিঠাকুরের বিশ্ব-যাত্রা।
১৮৭৮ সাল। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ১৭। ভাবুক প্রকৃতির রবীন্দ্রনাথকে অন্তত কাজচালানোর মতো ইংরেজি শিখিয়ে ইউরোপে পাঠানো হয় ঠাকুরবাড়ির তরফ থেকে। ঘরকুনো ছেলেটির মনে জমে থাকা ক্ষোভ বারুদকণার মতো জমাট বেঁধে থাকত দেশে পাঠানো চিঠিগুলোর শব্দের আড়ালে। ভালো মন্দের মিশেলে যে অভিজ্ঞতা, দেশের জন্য মনখারাপ, তরুণ আবেগ —সব নিয়েই সেই পত্রগুলো পরে প্রকাশিত হতে শুরু করলো ‘ভারতী’ পত্রিকার পাতায়। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক। মোট ১৩টি ব্যক্তিগত পত্র প্রকাশিত হয়েছিল সেই সময়।

রবীন্দ্রনাথ দুবার ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। একবার ১৭ বছর বয়সে, উচ্চশিক্ষা হেতু। আর দ্বিতীয়বার ১৯১২ সালে। এ যাত্রার আদ্যোপান্ত অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তিনি বর্ণনা করেছেন তার ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’, ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরি’, ‘জীবনস্মৃতি’ প্রভৃতি গ্রন্থে। এসব লেখা এতটাই সুখপাঠ্য যে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ভ্রমণকাহিনীগুলোর অন্যতম হয়ে থাকবে রবীন্দ্রনাথের এসব ভ্রমণকাহিনী।

কিশোর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ‘পুনা’ স্টিমার যখন রওনা দিয়েছিল বিলেতের পথে, যখন চোখের সামনে থেকে ভারতবর্ষের তটরেখা মিলিয়ে যাচ্ছিল, তখন এক আশ্চর্য মনখারাপ আর সমুদ্রপীড়ায় জর্জরিত কিশোর রবীন্দ্রনাথ জীবনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলেন। বিলেতের উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে রবীন্দ্রনাথ জাহাজে চড়ার কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। জাহাজের যাত্রা, পরিবেশ, আবহাওয়ার সাথে তখনও খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি তিনি। বইয়ের ভাষায়, এই অসুস্থতাকে অবশ্য ‘সি সিকনেস’ নামে অভিহিত করা হয়। এমন ‘সমুদ্র ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কিশোর কবি একেবারে ছয়টি দিন বিছানায়। সে সময় জাহাজের জনৈক ‘স্টুঅর্ড’ তাকে পরম মমতায় খাইয়ে দিতেন। ছদিন পর যখন কবি শয্যা ছেড়ে উঠলেন, তখন দেখলেন, আসলেই তিনি ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়েছেন।

কবির ভাষায়, ‘‘উঠে দেখি যে সত্যিই ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়েছি। মাথা যেন ধার করা, কাঁধের সাথে তার ভালোরকম বনে না, চুরি করা কাপড়ের মতো শরীরটা আমার যেন ঠিক গায়ে লাগছে না। ঘর থেকে বেরিয়ে ছাতের উপর গিয়ে একটা কেদারায় হেলান দিয়ে পড়লেম। অনেকদিন পর বাতাস পেয়ে বাঁচলেম।’’

এডেন থেকে জাহাজে করে সুয়েজ যেতে তাদের পাঁচদিন লেগেছিল। সুয়েজে নেমে নৌকোয় করে খানিকটা পথ এগিয়ে ট্রেনে করে আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে পৌঁছে সেখান থেকে স্টিমারে চেপে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইতালি পৌঁছান কবি। কবি জানতেন যে, আফ্রিকা এক অনুর্বর মরুভূমির নাম, অন্তত বই-পুস্তকে তো তেমনটিই পড়েছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখলেন উল্টো। রাস্তার দুপাশে তিনি বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত দেখেছেন, দেখেছেন থোকায় থোকায় খেজুরশুদ্ধ গাছ, আরো কতো কী!

হাঁটতে হাঁটতে একেবারে ধূলোবালি মেখে মলিন বদনে পৌঁছলেন আলেকজান্দ্রিয়া। বন্দরে তাদের জন্য অপেক্ষমাণ ‘মঙ্গোলিয়া’ জাহাজে চেপে তারা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেন। আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি বেশিরভাগ দোকানের সাইনবোর্ড ফরাসি ভাষায় লেখা। এখানের বিশাল বন্দরে ইউরোপীয়, মুসলমান সব ধরনের জাতির জাহাজ আছে, শুধুমাত্র হিন্দুদের কোনো জাহাজ নেই। এই ঘটনা তাকে বিষণ্ণ করেছিল।

জাহাজে করে ইতালিতে পৌঁছতে লাগলো পাঁচদিন, তখন রাত ২ টা। রাতে ব্রিন্দিসির হোটেলে থাকতে হলো। পরদিন একটি আধভাঙা গাড়ি করে শহর দেখতে বেরোলেন। কিশোর কবি রসবোধের ঘাটতি ছিলো না। সেখানে একজন বুড়ি ফল বিক্রেতা রবীন্দ্রনাথদেরকে অনুনয় করলেও তার ফল কেনার ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু একজন সুন্দরী মেয়েকে দেখে আর ওকে উপেক্ষা করলেন না। ভ্রমণকাহিনীর এ পর্যায়ে ইতালির মেয়েদের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে ভুল হলো না কিশোর কবির। কবির দৃষ্টিতে, ‘ইতালির মেয়েরা সুন্দরী, তাদের চোখ, চুল, ভ্রু কালো অনেকটা আমাদের দেশের মতো।’

ব্রিন্দিসি শহর থেকে ট্রেনে করে প্যারিস শহরের দিকে যাত্রা করেন কবি। নানা বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে অবশেষে তিনি প্যারিস পৌঁছান। রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৮ সালে সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে ইংল্যান্ডে যান।

রবীন্দ্রনাথ নেহাতই কোনো পথচলতি মুসাফেরের মতোন বিলেতযাত্রা করেননি। ইউরোপীয় অবস্থাপন্ন বাড়িতে অতিথি হিসেবে থেকেছেন। ব্রাইটন শহরে ঠাকুর বাড়িতে থাকেন কিছু দিন। সেখানে তিনি একটি স্কুলে (অনেকের মতে, ব্রাইটন কলেজে) ভর্তি হন। কিছু দিন পর, আরো ভালো লেখাপড়ার উদ্দেশে তিনি বড় ভাইয়ের এক বন্ধুর সাথে লন্ডন চলে যান। ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে, আইনবিভাগে। কিন্তু থাকা-খাওয়া নিয়ে বাঁধলো বিপত্তি। পরে একজন ডক্টরের বাসায় পেয়িং গেস্ট হিসেবে রবীন্দ্রনাথ থাকবেন বলে ঠিক হলো। পেয়িং গেস্ট মানে অনেকটা সাবলেট থাকার মতো। কোনো একটা পরিবারের সাথে থাকবে, খাবে, বিনিময়ে টাকা পে করবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ ছিলেন না, তাই যে পরিবারে তিনি থাকবেন, সে পরিবারের প্রত্যেকের ছিল ঘোর আপত্তি।

প্রথম প্রথম রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডের আবহাওয়া ও এখানকার মানুষদের আচার-প্রথা নিয়ে খুবই বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডের মানুষদের পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে কড়া মন্তব্যও করেন। ইংল্যান্ডের মানুষের জীবনযাত্রা এত ব্যস্ত যে রবীন্দ্রনাথের তা মোটেও ভালো লাগেনি।

রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট ফর্সা ছিলেন। তবে, ইউরোপীয়দের মতো তিনি তো আর ‘শ্বেতাঙ্গ’ ছিলেন না। সেজন্যে তাকে প্রায়ই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। ইংল্যান্ডবাসীরা অশ্বেতাঙ্গ নন-ইউরোপীয়দের নিতান্তই সেকেলে মনে করে, তা জানতেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তারা যে নন-ইউরোপীয় বা ভারতবর্ষের লোকেদের এতটাই অবুঝ মনে করে, তা কবি ভাবতেই পারেন না। তাদের কিছু কিছু আচরণে কবি আসলেই হতভম্ব হয়ে যান।

ইংল্যান্ডে থাকাকালীন একবার এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সবাই মিলে ধরলো তাকে, একটা গান শোনাবার জন্য। রবীন্দ্রনাথ গাইলেন, ‘প্রেমের কথা আর বলো না’। গানটি শুনে এক ভদ্রমহিলা তার কাছে এর অর্থ জানতে চাইলেন। কিশোর রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে গানটি অনুবাদ করে দিলে ভদ্রমহিলা অমনি বলে বসেন, ‘তোমাদের দেশে প্রেমের স্বাধীনতা আছে নাকি!’

প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথ বিলেতের প্রতি আকর্ষণ অনুভব না করলেও ধীরে ধীরে তিনি বিলেতের মানুষদের উন্নত সভ্যতা, মার্জিত ও ভদ্রোচিত আচার-ব্যবহারে মুগ্ধ হতে থাকেন। বিশেষত তিনি যে বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকতেন, সে বাড়ির গৃহকর্তাদের অমায়িক ব্যবহারে তিনি প্রসন্ন হন এবং দীর্ঘসময় তিনি সেই স্মৃতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলোতে ইংল্যান্ডবাসীদের প্রশস্তি গাওয়া হতে থাকলো। এতে করে, রবীন্দ্রনাথের বাবা-মা ভাবলেন, ছেলে আমার কবি মানুষ, ইংল্যান্ডের মোহে পড়ে যদি আবার কবি মাইকেল মধুসূদনের মতো স্বদেশ-স্বধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়ে যায়, তাহলে সমস্যায়ই পড়তে হবে বটে।
এসব কারণেই তারা রবীন্দ্রনাথকে ব্যারিস্টারি সমাপ্ত না করেই মাঝ পথেই ভারতবর্ষে ফিরিয়ে আনেন। ১৮৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয় কিশোর কবির এই দেড় বছরের বিলেত যাত্রা।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের এই বিলেত যাত্রা তার সাহিত্য রচনার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। সাহিত্য রচনায় তার যে আধুনিকতার ছাপ দেখা যায়, তাতে এই বিলেত ভ্রমণ প্রধান ভূমিকা রেখেছে। তিনি বেশ কিছু গান রচনা করেছেন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ভাব, বাণী ও সুর অবলম্বনে। বিলেত ভ্রমণের পর পরই তিনি রচনা করেন কয়েকটি গীতিনাট্য, যেখানে পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাব স্পষ্টত লক্ষণীয়। বিলেত সফরের আগেকার রবীন্দ্রনাথ আর বিলেত সফরের পরের রবীন্দ্রনাথ- এই দুই সত্তা অভিন্ন নয়। যে ডিগ্রি লাভের উদ্দেশ্যে এই যাত্রা, সে ডিগ্রি তিনি লাভ করতে পারলেন না। তবে যা লাভ করেছেন, নিঃসন্দেহে তা তার সাহিত্যিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

Back to top button