আন্তর্জাতিক

পিরামিডের দেশে ‘হিন্দু মন্দির’! কিন্তু ভৌতিক কারণে এর তুমুল বদনাম

এই অপূর্ব শিল্প নিদর্শনটিকে ঘিরে কিন্তু বিরাজ করছে রহস্যের এক কালো ছায়া। এই প্রাসাদ ‘মিশরের সব থেকে ভৌতিক প্রসাদ’-এর তালিকায় স্থান পায় ১৯৯০-এর দশকে।

 

পিরামিডের দেশে ‘হিন্দু মন্দির’! শুনতে আশ্চর্য লাগলেও কথাটা সত্যি। মিশরের রাজধানী কায়রো শহরের উপকণ্ঠ হোলিওপলিসেই রয়েছে এই বিস্ময়কর স্থাপত্য নিদর্শনটি। দেখতে পুরোপুরি হিন্দু মন্দিরের মতো হলেও এটি আসলে এক প্রাসাদ। এর পোশাকি নাম— ‘লে পালাই হিন্দোউ’ বা সাদা বাংলায় ‘হিন্দু প্রাসাদ’। ১৯০৭ থেকে ১৯১১ সালের মধ্যে এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেন বেলজিয়ান ইঞ্জিনিয়ার, উদ্যোগপতি, ধনকুবের এদুয়ার লুই জোসেফ, যিনি ব্যারন এমপেইন হিসেবেই সমাধিক প্রসিদ্ধ।

১৯ শতকের শেষ দিক থেকে বিংশ শতকের গোড়া— এই কালপর্বে ইউরোপের এক বিপুল অংশের শিক্ষিত এলিট প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার দিকে ঝোঁকেন। এঁদের অনেকেই এই চর্চাকে পুঁথিপাতড়ায় সীমায়িত না রেখে নিজেদের জীবনযাপনেও প্রয়োগ করতে শুরু করেন। ব্যারন এমপেইন সেই সব প্রাচ্যবিদদের মধ্যেই অন্যতম। তিনি প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা ও তার বিস্তৃত রূপটি সম্পর্কে খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি অপেশাদার ভাবে মিশরতত্ত্বের চর্চাও করতেন। ১৯০৭ সালে তিনি মিশরের হেলিওপলিসে এই প্রাসাদ নির্মাণের বরাত দেন ফরাসি স্থপতি আলেকজান্দ্রে মার্সেলকে। কম্বোডিয়ার আঙ্কোর ভাট-এর বিখ্যাত হিন্দু মন্দিরের সঙ্গে ওড়িশার মন্দির শৈলী মিশিয়ে তৈরি করা হয় এই প্রাসাদ। আজও এই প্রাসাদ এক দ্রষ্টব্য বিষয় পর্যটকদের কাছে।

শুধু মন্দিরের অবয়ব নয়, এই প্রাসাদের সারা গায়ে রয়েছে অসংখ্য হিন্দু দেবদেবীর রিলিফ। হনুমান, বিষ্ণু, গরূড়, কৃষ্ণ প্রমুখের মূর্তি ছাড়াও প্রাসাদের ভিতরের দেওয়ালে আঁকা রয়েছে হিন্দু পৌরাণিক দৃশ্যাবলি।

মন্দিরের মূল মিনারে ব্যারন এমপেইন নিজে থাকতেন। তাঁর কক্ষটি এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে, তা ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যেতে পারে। প্রাসাদ ঘিরে রয়েছে সুদৃশ্য বাগান। সেখানে আবার বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে, রয়েছে বেশ কিছু রতিভাস্কর্যও।

এই অপূর্ব শিল্প নিদর্শনটিকে ঘিরে কিন্তু বিরাজ করছে রহস্যের এক কালো ছায়া। ব্যারন এমপেইনের পরিবার তিন প্রজন্ম ধরে এই প্রাসাদে বাস করে। এই প্রাসাদেই ব্যারনের বোন হেলেনা এক রহস্যময় পরিস্থিতিতে রিভলভিং মিনারের ব্যালকনি থেকে পড়ে মারা যান। এমপেইনের কন্যা মানসিক রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং প্রাসাদের এলিভেটরে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ব্যারন নিজে মারা যান ১৯২৯ সালে। তার পরেও এই প্রাসাদে তাঁর নাতি-নাতনিরা থাকতেন।

১৯৫২ সালে মিশরের রাজা ফারুককে সিংহাসনচ্যুত করেন গামাল নাসের। মিশরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ ঘোরালো হয়ে ওঠে। মিশরে বাসরত ইউরোপীয়রা দলে দলে দেশে ফিরে যেতে শুরু করেন। এমপেইন পরিবার প্যারিসে চলে যায়। প্রাসাদটি বিক্রি হয়ে যায় এক সৌদি সংস্থার কাছে। সৌদি সংস্থা প্রাসাদটি দীর্ঘদিন তালাবন্ধ রাখে এবং প্রাসাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।

এই সময় থেকেই প্রাসাদে প্রেতাত্মার দৌরাত্ম্য শুরু হয় বলে জানা যায়। ১৯৯০-এর দশকে এই বদনাম চরমে ওঠে বলে জানাচ্ছে ‘লাইভ হিস্ট্রি ইন্ডিয়া’ নামের এক ওয়েব পত্রিকা। অচিরেই এই প্রাসাদ ‘মিশরের সব থেকে ভৌতিক প্রসাদ’-এর তালিকায় স্থান পায়। ১৯৯০-এর দশকেই এখানে হোটেল তৈরির প্রস্তাব আসে, ক্যাসিনো তৈরির কথাও হয়। কিন্তু কোনওটাই বাস্তবায়িত হয়নি। মিশরের ভারতীয় দূতাবাস এখানে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরির কথাও ভাবে। কিন্তু তা-ও ঘটেনি। ২০১৭-এ এই প্রাসাদের সংস্কার শুরু করেছে মিশর সরকার। কিন্তু রাতের দিকে কেউই থাকতে চায় না এখানে। কাকে দেখে, কোন শব্দ শুনে এই ভয়, তা নিয়েও মুখ খুলতে চান না ভুক্তভোগীরা।

পিরামিডের দেশে এক খণ্ড ভারত দাঁড়িয়ে থাকে তার প্রেত-সুলভ অস্তিত্ব নিয়ে।

Back to top button