অফবিট

বিশেষ: পি সি সরকার দেখিয়েছিলেন এমন জাদু ,যা পদত্যাগ করিয়েছিলো মন্ত্রীকেও

একদিন কলকাতার ইম্পেরিয়াল রেস্তোরাঁয় ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক। সেখানেই হাজির হয়েছেন এক বাঙালি জাদুকর। জাদুকর বললেন, হক সাহেবকে নিজের জাদু দেখাবেন। এতে রাজিও হলেন তিনি।
জাদুকরের কথামতো, সাধারণ একটা কাগজের টুকরোয় কিছু লিখলেন। সইও করলেন সেখানে। সেখানে উপস্থিত বাকি মন্ত্রীরাও তার তলায় সই করলেন। ঠিক তারপরই ঘটল এক মহাবিপদ।

সেই জাদুকরের মন্ত্রবলে, সেই সামান্য কাগজ হয়ে গেল পদত্যাগপত্র! ফজলুল হক মন্ত্রিত্ব হারালেন, আর সেই মুহূর্তের জন্য সিংহাসনে বসলেন সেই জাদুকর। সেই বাঙালি জাদুকরের নাম প্রতুল চন্দ্র সরকার! যাকে অনেকেই চেনে পি সি সরকার সিনিয়র হিসেবে।

প্রতুলচন্দ্র সরকার ১৯১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার অশোকপুর গ্রামে একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। তার জাদু ১৯৩০ সালের দিকে জনপ্রিয় হওয়া শুরু হয়।

নিজের ইন্দ্রজালে গোটা বিশ্বের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন এই জাদুকর। নিখাদ ভারতীয় পোশাকে, পাগড়ি পরে একজন স্রেফ ধাঁধিয়ে দিয়েছেন মানুষকে। পি সি সরকার এইভাবেই বিজ্ঞান এবং যুক্তির মিছিলে আমাদের ম্যাজিক চেনালেন।

ছোট থেকেই জাদুর প্রতি উৎসাহ ছিল প্রতুল সরকারের। স্কুলে পড়তে পড়তেই হাতেখড়ি শুরু। সেসময় গুরু হিসেবে পায়ে যান কিংবদন্তি জাদুকর গণপতি চক্রবর্তীকে। যাকে বাংলার আধুনিক জাদুবিদ্যার জনক বলা হয়। প্রতুল সরকার জাদু শিখতে থাকেন তার কাছে। এসবের পাশাপাশি চলছিল পড়ালেখাও, কোনোদিন ফাঁকি দেননি সেইদিকেও। গনিতে স্নাতক শেষ করেই মনস্থির করে ফেলেন তিনি। জাদুই হবে তার এক ও একমাত্র দুনিয়া।

নিজের জীবদ্দশায় বহু দুঃসাহসিক জাদু দেখিয়েছেন তিনি। অনেক ম্যাজিক তার একান্ত নিজেরই আবিষ্কার। ‘ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া’, ‘ফ্লটিং লেডি’, ‘এক্স-রে ভিশন’ ইত্যাদি বিখ্যাত ম্যাজিকগুলোতো রয়েইছে। সেই সঙ্গে রয়েছে একটি আস্ত মানুষকে দ্বিখণ্ডিত করে দেওয়ার ম্যাজিক। যা নিয়ে ১৯৫৬ সালে বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল আমেরিকায়। একজন তরুণীকে সবার সামনে করাত দিয়ে, মঞ্চের মধ্যেই দুইভাগ করে দিলেন এক ভারতীয় জাদুকর! এ কি ধরনের নৃশংসতা! এর আগে এইরকম ম্যাজিক তো দেখেনি কেউ। ব্যস, যাকে বলে আলোড়ন পড়ে গেল।

পরেরদিনই খবরের কাগজে হেডলাইন হলেন তিনি। তবে পি সি সরকার সিনিয়রের শো-এর টিআরপি এক বিন্দুও কমেনি। তারপর থেকে সমস্ত শো-ই হাউজফুল হয়েছিল তার।

ম্যাজিক আর বিজ্ঞান— এই দুটোকে কখনোই আলাদা করে দেখেননি প্রতুল সরকার। এমনকি, প্রাচীনকালের কিছু ম্যাজিকের মূল সূত্রও তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। তার এই অবদানকে সম্মান জানিয়েছে বিশ্বও। পেয়েছেন ম্যাজিকের অস্কার ‘দ্য স্ফিংক্স’ পুরস্কার। ভারত সরকারের থেকে পেয়েছেন পদ্মশ্রী সম্মানও। জাপান, আমেরিকা, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড— ৭০টিরও বেশি দেশে জাদু দেখিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে নিয়ে গেছেন ভারতের ঐতিহ্যকে, সংস্কৃতিকে। নিজের পোশাকের মধ্যেও সবসময় সেটা বহন করতেন তিনি।

জীবনের অধিকাংশ সময় মঞ্চেই কাটিয়েছেন পি সি সরকার। এমনকি, মৃত্যুও এসেছিল সেই মঞ্চেই। ১৯৭১ সালে জাপানে জাদু দেখাতে দেখাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হন পি সি সরকার সিনিয়র। মারা যান সেখানেই। সশরীরে না থাকলেও, তার সৃষ্ট ম্যাজিকে আজো মোহিত হই আমরা। ম্যাজিকের পাশাপাশি চিনতে শিখি বিজ্ঞানকেও।

এসবের সম্মানে বেশ কিছু স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। ভারত সরকার ‘জাদু সম্রাট পি.সি সরকার’ নামে কলকাতাতে একটি সড়কের নামকরণ করেছে। ১৯৬৪ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৪৬ ও ১৯৫৪ সালে জাদুর অস্কার নামে পরিচিত ‘দ্য ফিনিক্স’ (আমেরিকা) পুরস্কার লাভ করেন তিনি। জার্মান মেজিক সার্কেল থেকে ‘দ্য রয়াল মেডিলিয়ন’ পুরস্কার পান। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সালে ভারতীয় সরকার তার প্রতি সম্মান জানিয়ে একটি পাঁচ টাকার স্ট্যাম্প চালু করে।

Back to top button